ইবনে বতুতা – জীবনী ও বাংলাদেশ ভ্রমণ

ইবনে বতুতা (Ibn e Batuta) – জীবনী ও বাংলা ভ্রমণ 

আমরা যারা ঘুরতে ভালোবাসি, তাদের সবার কাছেই একটি নাম সবচেয়ে পরিচিত সে হচ্ছে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়া ইবনে বতুতা। তিনি একজন বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক, চিন্তাবিদ, বিচারক এবং একজন ধর্মতাত্ত্বিক। বিশ্ব বিখ্যাত এ ভ্রমণ পিপাসু ব্যক্তি ঘুরে বেড়িয়েছেন আফ্রিকা থেকে ভারত উপমহাদেশ, ভারত থেকে তুরস্ক পর্যন্ত। এমনকি বাংলাদেশেও তার পদ চিহ্ন পড়েছে। তিনি বিশাল এ পথ পাড়ি দিয়েছেন কখনো নদী পথে, কখনো উট কাফেলায় আবার কখনো বা পায়ে হেঁটে। ২১ বছর বয়স থেকে তার এ ভ্রমণ শুরু এর পরে প্রায় টানা ৩০ বছর বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন। অনেকে মার্কো পালোকে তার সমকক্ষ মনে করেন। তবে মার্কো পালোর চেয়ে ইবনে বতুতা বেশি অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন। এ কারনে অধিকাংশ ইতিহাসিবিদ ইবনে বতুতাকেই বিশ্বের সেরা ভ্রমণকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

পরিচয়

ইবনে বতুতা ১৩০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রবিবার দিন মরোক্কোর তাঞ্জিয়ার নামক স্থানে এক মুসলিম বিচারপতির ঘরে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পুরো নাম শেখ আবু আবদুল্লাহ মুহম্মদ।চীনসহ পৃথিবীর অনেক যায়গায় তিনি “শামস-উদ-দীন” নামেও পরিচিত ।

ইবনে বতুতার বিশ্ব ভ্রমণ

ইবন বতুতা সারা জীবন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমন করে বেরিয়েছেন।মূলত তিনি পৃথিবী ভ্রমণের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন।২১ বছর বয়সে প্রথম তিনি পবিত্র হজ পালন করার উদ্দেশ্যে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন। আর একুশ বছর থেকে শুরু করে জীবনের পরবর্তী ৩০ বছরে তিনি প্রায় ৭৫,০০০ মাইল(১,২০,০০০কিমি) অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছেন বলে জানা যায়। তিনি সময়কার সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন এবং এর সুলতানদের সাথে স্বাক্ষাত করেছেন। বর্তমান পশ্চিম আফ্রিকা থেকে শুরু করে মিশর, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীন ভ্রমণ করেছিলেন। তার কিছুকাল পূর্বে এমন দীর্ঘ ভ্রমণ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন ভেনিসের ব্যাবসায়ী এবং পরিব্রাজক মার্কো পোলো। কিন্তু তিনি মার্কো পোলোর চেয়েও তিনগুন বেশি পথ সফর করেছেন।

মক্কায় প্রথম হজ্জ

১৩২৫ সালের ১৪ ই জুন তারিখে ইবন বতুতার বয়স ছিল ২১ বছর ৪ মাস। ১৪ জুন তিনি মরক্কোর তানজানিয়ার থেকে মক্কা নগরীতে গিয়ে হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে জন্মভূমি ত্যাগ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি উত্তর আফ্রিকার সাগর তীর ধরে পায়ে হেটে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথিমধ্যে তিনি আব্দ-আল-ওয়াদিদ এবং হাফসিদ সম্রাজ্য, তিমসান, বিজাইরা এবং তিউনিস অতিক্রম করে মক্কায় পৌঁছান। আরব বেদুইনদের থেকে নিরাপদ থাকতে এবং অন্যান্য সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কাফেলার সাথে এই পথ অতিক্রম করতেন।
১৩২৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে উপকূলীয় পথে সাফাক্স হয়ে কাবিস শহরে পৌঁছান। কাবিস শহরে তিনি তিউনিসের এক উকিলের মেয়েকে চুক্তিতে বিয়ে করেন।পরবর্তীতে ত্রিপলি আসতে আসতে ঐ উকিলের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ায় এই বিয়ে বেশিদিন স্থায়ী হয় নি।বতুতা ত্রিপলির পরবর্তী শহর ফেজে এসে তার এক ছাত্রের মেয়েকে বিয়ে করেন।

ইবন বতুতা ১৩২৬ সালের ৫ই এপ্রিল আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে পৌঁছান। আলেক্সান্দ্রিয়ায় থাকা কালীন তিনি ২জন ধার্মিক তপস্বীর সাথে দেখা করেন। একজন হল শেখ বোরহানউদ্দিন, তিনি ইবনে বতুতাকে তার বিশ্ব ভ্রমণ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেন যে,

‘আমার মনে হচ্ছে তুমি বিদেশ ভ্রমণ পছন্দ করো। তুমি ভারতে আমার ভাই ফরিদউদ্দিন, সিন্ধু প্রদেশ রুকনউদ্দিন এবং চীনে বুরহানউদ্দিনের সাথে দেখা করবে এবং আমার শুভেচ্ছা পৌঁছে দেবে।’

অপর ব্যক্তি হলেন শেখ মুর্শিদি, তিনি ইবনে বতুতার একটি স্বপ্লের অর্থ ব্যাখ্যা প্রদান করে ছিলেন। এদুই ব্যক্তির অনুপ্রেরণায় ইবনে বতুতা বিশ্ব ভ্রমণে অনুপ্রানিত হন।

এক সপ্তাহ পরে তিনি মামলুক সালতানাতের রাজধানী কায়রো দিকে যাত্রা করেন। একমাস কায়রোতে অবস্থানের পরে পরে তিনি নীল নদ পার হয়ে আইদাব বন্দর পার হয়ে মক্কা যাবার একটি অল্প পরিচিত পথে মক্কা অভিমূখে যাত্রা করেন। বন্দর অধিবাসীরা তাকে পুনরায় কায়রো ফেরত পাঠায়। কায়রো থেকে সুফি আবদুল আল সাদিদির পরামর্শে সিরিয়া হয়ে মক্কা যাবার পরামর্শ প্রদান করেন। সিরিয়ার দামেস্কে পৌছে সেখানে এক মাস কাটিয়ে মদিনাগামী একটি কাফেলার সাথে যোগ দেন। মদিনায় পৌছে মহানবী (সা.) এর কবর জিয়ারত করে চারদিন পরে মক্কা অভিমুখে যাত্রা আরম্ভ করেন। মক্কায় তিনি একমাস অবস্থান করেন।

মক্কা পৌঁছে হজ্জ পালন করে তিনি তাঞ্জিয়ার ফিরে যাওয়ার বদলে মধ্য এশিয়ার দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ইরাক ও পারস্য

মক্কা থেকে তিনি ১৩২৬ সালের নভেম্বরের ১৭ তারিখ আরব সাগর হয়ে ইরাকের উদ্দেশ্যে এক কাফেলার সাথে যোগ দেন। এই কাফেলা তাকে নাজাফ শহরে নিয়ে যায় । নাজাফ শহরে হহযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলি (রা.) এর মাজার জিয়ারত শেষে বতুতা কাফেলা ইরাকের উদ্দেশ্যে রওয়া দিলেও তিনি কাফেলার সাথে না গিয়ে আরো দক্ষিণে টাইগ্রিস নদী পার হয়ে বসরা নগরির দিকে রওনা করেন। এর পর তিনি বসরা থেকে পারস্যের তখনকার সবচেয়ে বিখ্যাত ইস্পাহান শহরের দিকে যাত্রা আরম্ভ করেন। ইস্পাহান থেকে তিনি মোঙ্গল আক্রমণে বিপর্যস্ত শিরাজ শহরে যান । শিরাজ ত্যাগ করে ১৩২৭ সালের জুন মাসে বাগদাদে পৌঁছেন। তখনও চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খান কতৃক ১২৫৮ সালে বাগদাদ আক্রমণের স্পষ্ট চিহ্ন দেখতে পানে।

বাগদাদের শেষ মোজ্ঞল সম্রাট আবু সাইদের সাথে সাক্ষাত করলে সাউদের পরামর্শে রাজকীয় কাফেলার সাথে তিনি উত্তরের সিল্ক রোড হয়ে তাবরিজ শহরে গমন করেন। ধারনা করা হয় তাবরিজ থেকে ইবনে বতুতা জুলাই মাসে পুনরায় বাগদাদের উদ্দেশে রওনা দেন। পথে তিনি সিজরা ও মারদিন শহরগুলো ভ্রমণ করেন। সিনজার থেকে একটি কাফেলার সাথে যোগ দিয়ে পুনরায় মক্কায় প্রবেশ করে দ্বিতীয় বারের মত হজ্জ পালন করেন। এর পর ৩ বছর তিনি মক্কাতেই অবস্থান করেন। যদিও এটি নিয়ে মত বিরোধ রয়েছে।

আরব উপদ্বীপ

মক্কাতে ৩ বছরকাল অবস্থান করে ১৩৩০ সালের হজ্জ পালন করেন। কেউ কেউ এই সময় নিয়ে দ্বিমত পোষন করেন। অনেকের মতে তিনি ১৩২৮ সালের হজ্জ পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি জেদ্দা থেকে লোহিত সাগরের দিকে যাত্রা আরম্ভ করেন। নৌকার সাহায্যে তিনি ইয়েমেন পৌঁছে তা’ইজ শহরে সুলতান নুর-উদ-দিনের সাথে সাক্ষান করেন। এর পরে তিনি রাজধানী সানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। যদিও এ ভ্রমণের বিস্তারিত পাওয়া যায় না। তবে ধাওনা অনুযায়ী তিনি ১৩২৯ থেকে ১৩৩১ সালের মধ্যে কোন এক সময় তা;ইহ থেকে রওনা দিয়ে তখনকার গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর এডেন চলে আসেন।

ইবনে বতুতা

সোমালিয়া ও সাওয়াহিলি তীরে গমন

এডেন বন্দর থেকে জাহাজে করে চারদিনের যাত্রা পথ সোমালিয়ার জায়লা (বর্তমানে বারবারাহ আরবি শব্দ বারবারাহ অর্থ আফ্রিকার শিং) শহরে পদার্পন করেন। জায়লা শহর থেকে পনের দিনের যাত্রা শেষে ম্যাকদ্যাশ’অ (মোগাদিশু) পৌঁছান। ইবনে বতুতা মোগাদিসুকে একটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করেন। নানা অঞ্চল থেকে বণিকেরা মোগাদিসু বন্দরে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যে আসত। মোগাদিসু থেকে বণিকেরা একপ্রকার সুতি কাপড় নিয়ে মিশর , সিরিয়াসহ অন্যান্য অঞ্চলে নিয়ে রফতানি করত। তৎকালীন মোগদিসুর সুলতান আবু বকরের অতিথিয়তায় চারদিন অবস্থান করে তিনি সাওয়াহিলির (অর্থ উপকূলীয় এলাকা) উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

সাওয়াহি’লি তৎকালীন সময়ে “বিলদ-আল-জাঞ্জ” নামে পরিচিত ছিল যার অর্থ হল জাঞ্জদের ভূমি। জাঞ্জ শব্দটা কোন ভাষা থেকে এসেছে তা জানা যায় না, তবে মধ্যযুগে আরবরা পূর্ব আফ্রিকার নিগ্রোদের এই নামে ডাকত। তিনি সায়াহিলি আগমন করেছিলেন তার অন্যতম কারন হল কুলওয়া শহর ভ্রমণ করা। এটি বর্তমানে কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ার অংশবিশেষ। ইবনে বতুতার বর্ণনা থেকে জানা যায় তখন সেখানকার সুলতান ছিলেন মুজাফফর হাসান যিনি ইসলামী শরিয়া মোতাবেক সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। ইবনে বতুতা বর্ণনা করেন সে সময় এ সুন্দর শহরটিতে খুব ভাল জাতের ঘোড়া পাওয়া যেতে।

এখান থেকে প্রশিক্ষিত ঘোড়া ভারতে রফতানি হত। মৌসুমি বায়ুতে পরিবর্তন আসতে থাকলে ১৩৩০ সালে তিনি ওমান ও হরমুজ প্রণালী হয়ে পুনরায় হজ্জ পালনের উদ্দেশে মক্কার দিকে রওনা দেন।

মধ্য এশিয়া আগমন

মোগাদিসু থেকে মক্কায় এসে এক বাছর অবস্থান করে তার ইচ্ছে হল তৎকালীন ভারতের সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের চাকরি করবেন। এ উদ্দেশ্যে ভারতের গাইড ও কাফেলার খুজে ১৩৩০ সালে তুরস্কের আনাতোলিয়া দিকে যাত্রা করেন। আনাতোলিয়া থেকে বণিকেরা ভারতবর্ষে গিয়ে ব্যবসা করত। সিরিয়ার লাতাকিয়া বন্দর থেকে জাজাযে করে তুরস্কের দক্ষিন আলানা পৌঁছান। এর পরে পায়ে হেটে কুনিয়া হয়ে কৃষ্ণ সাগরের তীরে পৌঁছান।

অতঃপর সিনোপ হয়ে আজাক শহরে পৌছে দেখেন সেখানকার আমীর রাজধানী সারা যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইবনে বতুতা আমীরকে তার সাথে নেওয়ার অনুরোধ করলে আমীর ইবনে বতুতাকে নিয়েই রওনা দেন। পথিমধ্যে আস্ত্রখানে সুলতানের ভ্রাম্যমান একটি গ্রামের দেখা পান। যেখানেই সুলতান তুঘলক খানের সাথে ইবনে বতুতার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। সুলতানের স্ত্রীদের সাথেও তার সাক্ষাৎ হয় সে সময় তিনিনি অনেক উপহার সামগ্রি পান। তুঘলক খানের তৃতীয় স্ত্রী বায়লুন ছিল কনস্টান্টিনোপোলের দোর্দোণ্ডপ্রতাপ সম্রাট আন্দ্রোনিকার তৃতীয় এর মেয়ে।

সম্রাটের স্ত্রী বায়লুন সেই সময় আন্তঃস্বত্বা ছিলেন এবং সুলতানের কাছে তার বাবার বাড়িতে সন্তান প্রসব করার ইচ্ছা পোষণ করলে সুলতান তাকে কনস্টান্টিনোপোলে যাবার অনুমতি দেন। সেই সাথে ইবন বতুতাকেও খাতুনের মহল্লার সাথে কনস্টান্টিনোপল যাওয়ার অনুমতি দেন। ইবনে বতুতা ১৩৩৪ সালের শেষের দিকে কনস্টান্টিনোপোল পৌঁছান। এটিই ছিল ইসলামী সম্রাজ্যের বাইরে ইবন বতুতার প্রথম সফর। কনস্টান্টিনোপলসম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে ইবন বতুতা তার বই “রিহলা” তে বলেন :

“শহরটা আকারের দিক দিয়ে ব্যাপক বিস্তৃত এবং মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া গোল্ডেন হর্ন নদীর জন্য শহরটি দুভাগে বিভক্ত। নদীতে নিয়মিত জোয়ার ভাটা হয় । অতীতে নদী পারাপারের জন্য সেতু ছিল কিন্তু সেটা ভেঙে যাওয়ায় এখন নৌকায় করে পার হতে হয়। এ নদীর পুব পাড়ের অংশের নাম ইস্তাম্বুল। এপাড়েই আছে সম্রাটের প্রাসাদ এবং গণ্যমান্যদের বাস। এ শহরের বাজার ও রাস্তাঘাট অনেক প্রশস্ত এবং পাথর দিয়ে বাধানো। প্রতিটা বাজারে প্রবেশের জন্য বড় বড় ফটক আছে, রাতে সেগুলো বন্ধ থাকে।”

ইবনে বতুতা কনস্টান্টিনোপোলের আয়া হেলেনা গির্জার বর্ণনা প্রদান করেন। যে গির্জাটির পরবর্তীতে নাম হয় সেন্ট হেলান। এই গির্জার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে জানা যায় যে এটি নির্মাণ করেছিলেন আসাফ, বেরেচিয়াহর ছেলে; যিনি হযরত সুলায়মান (আ.) এর ভাতিজা ছিলেন। গ্রিকদের যত গির্জা আছে সেন্ট হেলেনা তাদের মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার।গির্জাটির চার দিকে দেওয়াল দেওয়া দেখলে মনে হয় একটি শহর। কিছু সময় থাকার পর কনস্টান্টিনোপলথেকে অস্ত্রখানে ফিরে বতুতা জানতে পারেন যে সুলতান তুঘলক তার রাজধানীতে ফিরে গেছেন। তার রাজধানী সারায় গিয়ে সুলতানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারত এবং চায়নার উদ্দেশে রওনা হন।

ইবনে বতুতা
ইবনে বতুতা

ভারত বর্ষে আগমন

সারা থেকে যাত্রা করে তিন পরে খাওয়ারিজম হয়ে হিন্দুকুশ অতিক্রম করে ইবনে বতুতা গজনি পোঁছেন। পথিমধ্যে তিনি আফগানিস্থানের সমরখন্দ ও খুরাশানে যাত্রা বিরতি দেন। ১৩৩৩ সালের পহেলা মহরম সিন্ধুর পাঞ্জাবে পৌছেন বলে জানা যায়। সে সময় বহিরাগত কাউকে ভারতে ঢুকতে হলে সুলতানের অনুমতি নিতে হত। একই সাথে দিল্লি থেকে নির্দেশ আসত তাকে তাকে কোন শ্রেনীর পদমর্যাদা দেওয়া হবে। ইবনে বতুতার আগমন বার্তা সিন্ধের রাজধানী মুলতানের গভর্নরের কাছে এবং দিল্লির বাদশা সুলতান মোহাম্মদ শাহ এর কাছে পাঠানো হয়। স্বাভাবিকভাবে ডাক আসতে ৫০ দিন লাগলেও বাদশাহর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ডাক দিল্লিতে মাত্র পাঁচ দিনেই পৌছে যায়। শেষ পর্যন্ত ইবনে বতুতাকে “আজিজ” (সম্মানিত) পদবি দেওয়া হল।

পাঞ্জাব পার হয়ে নলখাগড়ার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে জননী শহর হয়ে সিওয়াসিতান পৌছান। এখানে খুরাশানের নামকরা ডাক্তার আলা আল-মুককের সাথে তার দেখা হয় এবং এ ডাক্তারের সাথেই তিনি পরবর্তীতে লাহোর পৌছান। সেখানে গভর্নরের সাথে পাঁচদিন থেকে আবোহার (Abuhar, পরবর্তীতে Abohar) হয়ে ভারতে পৌছান। আবোহর হল ভারতের মূল ভূ খন্ডের প্রথম শহর। সুতলতান তাকে দুটি গ্রাম থেকে রাজস্ব উত্তোলনের দায়িত্ব প্রদান করেন। বতুতার বাবা কাজী থাকায় তাকেও সুলতান মালিকি সম্প্রদায়ের কাজী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তার বেহিসেবী খরচে সুলতান বিরক্ত হন একই সাথে বতুতা সুলতানের আচরনে বিরক্ত হয়ে ভারত ছেড়ে যাবার মনস্থ করেন।

সুলতান চীনে দূত হিসেবে প্রেরণের কথা বললে তিনি রাজি হন। সুলতানের দেওয়া দুই টি জাহাজ , কর্মচারী ও কৃতদাস যাত্রাকালীন একদল ডাকাত দ্বারা আক্রান্ত হয়ে কো রকমে প্রাণে বেচে গুজরাটের দিকে রওনা দেন। গুজরাটে তিনি সুলতানের মূল্যবান উপটৌকোনগুলোর সুরক্ষার জন্য প্রায় পঞ্চাশ জন আবিসিনিয়ান হাবসি যোদ্ধা ভাড়া করলেন এবং কয়েকদিন যাত্রা করে অবশেষে কালিকোট বন্দরে পৌছান যেখান থেকে তার চীন যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল। আচমকা একটি ঝড় এসে তার দু’টি জাহাজ ডুবিয়ে দিলে তার আর দিল্লি ফেরত যাবার উপায় ছিল । কিন্ত তিনি চিনে যাবার জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাই মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করেন। ভারতে ইবন বতুতা প্রায় সাত বছর অবস্থান করেছিলেন।

মালদ্বীপ

ইবনে বতুতা ভারত ছেড়ে মালদ্বীপে এসে প্রায় নয় মাস অবস্থান করেন। এই নয় মাসে তিনি চারটি বিয়ে করেন। চারজন স্ত্রী’র মধ্যে আবার একজন রাজপরিবারের সদস্য ছিল। মালদ্বীপে ইবনে বতুতাকে কাজী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি তার লেখা বই “রিহলা” তে মালদ্বীপ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে

এখানকার মানুষেরা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসে এবং খালি পায়ে হাটে। মেয়েদের ব্যাপারে বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে এখানকার মেয়েরা শরিরের নিম্নাংশ সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে কিন্তু উর্ধাংশ অনাবৃত রাখে।

কাজী থাকা কালীন তিনি অনেক ইসলামী আইন চালু করতে সমর্থ হলেও মেয়েদের পোষাক নিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেন নি।মালদ্বীপে অবস্থানের শেষের দিকে ইবন বতুতার সাথে এখানকার উজিরের মনোমালিন্য দেখা দিলে তিনি সিলন (বর্তমান শ্রীলংকা) হয়ে চীন যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করেন এবং অবশেষে এ উদ্দেশ্যে একটি জাহাজে চড়ে বসেন।

শ্রীলংকা

শ্রীলংকা যাবার পথে মাদুরি উপকূলে তার জাহাজ প্রচন্ড ঝড়ে প্রায় ডুবে গিয়েছিল। এই অবস্থায় ডুবন্ত জাহাজের পেছনের পাটাতনে সমস্ত রাত কাটিয়ে দিলে একদল হিন্দু তাকে উদ্ধার করে সুলতানের দরবারে পৌঁছে দেয়। মাদুরিতে ভারতের সুলতান মোহাম্মদের গভর্নরের কাছে অবস্থান করেন। তিনি গভর্নরকে মালদ্বীপ আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ করে ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে একটি জাহাজে চড়ে বসেন। কিন্ত সে জাহাজটি দুর্ভাগ্যক্রমে জলদস্যু কতৃক আক্রান্ত হয়। সব হারিয়ে তিনি আবার মালদ্বীপে চলে যান। এর পরেও তিনি চিনে যাবার ইচ্ছা থেকে বিচ্যুত হন নি। তিনি মালদ্বীপ থেকে একটি চীনা বাণিজ্য যাহাজে করে চীনের উদ্দেশে রওনা দেন। টানা তেতাল্লিশ দিন যাত্রা শেষ করে তিনি বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌছান।

ইবনে বতুতা
ইবনে বতুতা

ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আগমন

মালদ্বীপ থেকে বাংলাদেশে আগমন নিয়ে ইবনে বতুতা নিজেই বলেনঃ

টানা তেতাল্লিশ রাত সাগরে কাটিয়ে অবশেষে আমরা বাংলাদেশ পৌছালাম। সবুজে ঘেরা বিশাল এক দেশ, প্রচুর চাল পাওয়া যায়। অন্য সব জিনিষও এত সস্তায় পাওয়া যায় সে দেশে যে এরকম আর কোথাও দেখি নি। তবে দেশটির আর সবকিছু হতাশাব্যাঞ্জক। খুরাশানের (বর্তমান আফগানিস্তান) লোকেরা দেশটিকে বলে “প্রানপ্রাচুর্যে ভরা জাহান্নাম”

ইবনে বতুতা ১৩৪৬ সালের ৯ জুলাই বাংলায় প্রবেশ করেন। তিনি প্রথমে যে শহরে প্রবেশ করেন তার উল্লেখ করেন সাদকাঁও বা চাটগাঁও। সেখান থেকে তিনি এক মাসের পথযাত্রায় কামারু বা কামরুপ পার্বত্য অঞ্চলে গমন কর সুফিসাধক শেখ জালাল উদ্দিনের (হযরত শাহজালাল র.) সাথে দেখা করেন। ইবনে বতুতা শেখ জালালউদ্দিনের জীবনাচরণ ও কর্মধারার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি দরবেশের দৈহিক গঠন, বয়স, তাঁর প্রতিদিনের আহার ও পরিধেয় বস্ত্র, অভ্যাস ও জীবনধারা, তপস্যা ও কৃচ্ছ্বসাধন, আধ্যাত্মিক শক্তি ও কেরামত, তাঁর আতিথেয়তা, সাফল্য ও জনপ্রিয়তা এবং তাঁর দরগাহের পারিপার্শিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। তার পর তিনি নদী পথে সুনুরকাঁও বা সোনারগাঁও যাত্রা করেন। ১৫ দিনে তিনি সোনারগাঁও শহরে এসে পৌঁছান। সোনারগাঁ থেকে একটি চীনা জাহাজে করে তিনি জাভার উদ্দেশে রওনা হন।

সাদকাঁও (চট্টগ্রাম) শহরে আসার পর থেকে সুনুরকাঁও (সোনারগাঁ) ত্যাগ করে জাভার উদ্দেশে রওনা হওয়া পর্যন্ত সময়কালে ইবনে বতুতার বাংলা সফরের মেয়াদ ছিল দুই মাসেরও কম সময় (১৩৪৬ সালের জুলাই ও আগস্ট মাস)। বাংলা ভ্রমণের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও নদীর নাম উল্লেখ করেন। স্থানগুলো হলো সাদকাঁও, কামারু, হবঙ্ক ও সুনুরকাঁও এবং নদী গঙ্গা, যুন ও আন-নহর উল-আয্রাক।

সাদকাঁও বা চাটগাওকে তিনি বলেছেন বিশাল সমুদ্র উপকূলবর্তী বিশাল শহর। এর কাছাকাছিই গঙ্গা ও যুন নদী মিলিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে।

কামারুকে (কামরূপের অসম্পূর্ণ প্রকাশ) বর্ণনা করা হয়েছে চীন থেকে তিববত পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল পার্বত্য অঞ্চল হিসেবে।তাঁর বর্ণনায়ই আমরা প্রথম কামরূপের অধিবাসীদের যাদুবিদ্যা ও সম্মোহনী মন্ত্রতন্ত্র চর্চা এবং এ বিদ্যায় তাদের নৈপুন্য ও অনুরক্তির উল্লেখ পাই। ইবনে বতুতা কামারু নামে যে স্থানটি পরিদর্শন করেন সম্ভবত তা ছিল খাসিয়া, জৈন্তিয়া ও ত্রিপুরা পাহাড় বেষ্টিত আসামের অন্তর্গত শ্রীহট্ট বা সিলেট অঞ্চল। এখানেই তিনি হযরত শাহজালাল (র.) এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ইবনে বতুতা হবঙ্ককে বর্ণনা করেছেন আন-নহর উল-আয্রাকের তীরবর্তী একটি অতি সমৃদ্ধ ও সুদৃশ্য নগররূপে। এই হবঙ্ক শহরকে সিলেটের পূর্বদিকে অবস্থিত ভাঙ্গারূপে শনাক্ত করা যায়। ইবনে বতুতা বর্ণিত এ শহরের ধ্বংসাবশেষের কোনো হদিস পাওয়া যায় নি। ঐতিহাসিক নগরী সোনারগাঁকে (সুনুরকাঁও) বলা হয়েছে একটি সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য নগর। তিনি তার বর্ণনাতে লক্ষ্ণোতি রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন কিন্ত তিনি সে রাজ্য ভ্রমণ করেন নি।

হযরত শাহ জালাল রহ. কে তিনি কেমন দেখলেন- সেটার বৃত্তান্তও ‘আর রিহলা’ গ্রন্থে পেশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘শাহজালাল একজন বড় মাপের ওলি এবং অনুপম ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর অনেক প্রসিদ্ধ কারামাত এবং বড় বড় কীর্তি রয়েছে। তা ছাড়া তিনি অনেক দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন। শাহ জালাল নিজে আমাকে বলেছেন, বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা মুসতা’সিম বিল্লাহকে তিনি দেখেছেন এবং তার হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে শাহ জালালের শিষ্যগণ আমাকে অবহিত করেছেন, শায়খ একশত পঞ্চাশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রায় চল্লিশ বছরের মতো তিনি একাধারে রোজা রেখেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি প্রতি দশ দিন পরপর ইফতার করতেন; তাও আবার নিজের পোষা একটি গাভীর দুধ দিয়ে। সারারাত নফল নামাজ পড়তেন। হালকা-পাতলা শরীর আর দীর্ঘকায়ের লোক ছিলেন তিনি। এতদঞ্চলের লোকেরা তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এ জন্যে তিনি এখানেই অবস্থান করেন।’

ইবনে বতুতা তাঁর বর্ণ্নাতে তিনটি নদীর নাম উল্লেখ করেছেন। নদীগুলো হল গঙ্গা, যুন ও আন-নহর উল-আয্রাক। তাঁর বর্ণনায় গঙ্গা ও যুন নদী সাদকাঁওয়ের নিকটে মিলিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। বর্ণনা অনুসারে দু”টি নদি যে আজকের পদ্মা ও যমুনা নদী সেটি বুঝা যায়।গঙ্গা নদীর বর্ণনায় ইবনে বতুতা পবিত্র নদী হিসেবে এর গুরুত্ব এবং নদীতে হিন্দুদের তীর্থস্নানের উল্লেখ করেছেন। আর উল্লেখিত নহর-উল-আয্রাক (নীল নদী) হবঙ্ক শহরের নিকট দিয়ে প্রবাহিত এবং যে নদীপথে বাঙ্গালাহ ও লক্ষ্ণৌতি রাজ্যে পৌঁছানো যায়, সেই নীলাভ জলের নদীকে স্পষ্টতই সুরমা রূপে চিহ্নিত করা যায়। আর এই সুরমা নদীপথে লক্ষ্ণৌতি রাজ্যে যেমন পৌঁছানো যায় তেমনি পৌঁছানো যায় সোনারগাঁয়ে।

ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে তখনকার বাংলার জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। বাংলার সুদৃশ্য শ্যামল সবুজ প্রান্তর, পল্লীর ছায়াসুনিবিড় সবুজের সমারোহ তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে, তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে মন্তব্য করেছেন,

‘আমরা পনের দিন নদীর দুপাশে সবুজ গ্রাম ও ফলফলাদির বাগানের মধ্য দিয়ে নৌকায় পাল তুলে চলেছি, মনে হয়েছে যেন আমরা কোনো পণ্যসমৃদ্ধ বাজারের মধ্য দিয়ে চলছি। নদীর দুই কূলে জমিতে জলসেচের পানি কল, সুদৃশ্য গ্রাম ও ফলের বাগান, যেমনটি রয়েছে মিশরের নীলনদের দুই তীরে।’

জীবন ধারনের জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর পর্যাপ্ততা আর মনভুলানো প্রাকৃতিক দৃশ্য বাংলাকে বসবাসের জন্যে আকর্ষনীয় করে তুললেও কুয়াশাচ্ছন আবহাওয়া , মেঘাচ্ছ আবহাওয়া, গুমোট আবহাওয়া, ভ্যাপসা গরম বিশেষত গ্রীষ্মকালে নদ-নদী থেকে উটাহ দাবদাহ এতটাই পীড়াদায়ক ছিল যে একে ‘দোজখ-ইপুর নিয়ামত’ অর্থাৎ প্রাচুর্যপূর্ণ নরক বলে অভিহিত করে।

ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে আমরা তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক অবস্থার কথা জানতে পারি। তিনি তখনকার বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহকে একজন খ্যাতিমান শাসক হিসেবে প্রশংসা করেছেন । ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন সে সময় এ সম্রাট বহিরাগতদের বিশেষত ফকির ও সুফি দরবেশদের পছন্দ করতেন। ইবনে বতুতা সোনারগাঁয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ও লক্ষ্ণৌতির সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহের মধ্যকার তীব্র সংঘর্ষের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছেন। বতুতা সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের সময় থেকে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ও আলাউদ্দিন আলী শাহের ক্ষমতা লাভের সময় পর্যন্ত বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাপটের বিবরণ দিয়েছেন। ইবনে বতুতা এ জন্য প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য যে, নিজে সুলতান মুহম্মদ তুগলকের একজন দূত হয়েও তিনি ফখরুদ্দিনকে দিল্লির সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে অবজ্ঞা করার মতো মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন, এবং স্পষ্টভাবেই তাঁকে উন্নত চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারীরূপে বর্ণনা করে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

ইবনে বতুতা তার বিবরনীতে বাংলার কতিপয় সামাজিক বিষয়ের উপর দৃষ্টিপাত করেন। সে সময় হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকের উপর সুফি-দরবেশদের প্রভাবের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।দেশের মুসলিম ও অমুসলিম অধিবাসীরা শেখ জালালউদ্দিনের খানকায় সমবেত হতো, দরবেশের সাক্ষাৎ গ্রহণ করত, এবং তাঁর জন্য নজর-নেওয়াজ নিয়ে আসত বলে ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন।প্রাপ্ত এই উপহার সামগ্রী দিয়েই দরগায় আগত ফকির ও মুসাফিররা জীবন ধারণ করত। সুলতানের আদেশ অনুসারে নদী পারাপারের জন্য সাধক ফকিরদের কোনো অর্থ প্রদান করতে হত না । স্থানীয় জনগণের কর্তব্য নির্ধারিত ছিল ফকির দরবেশদের বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করা। ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন সে সময় রাষ্ট্রীয় নির্দেশ মতে এমন রেওয়াজ ছিল যে, কোনো ফকির দরবেশ কোনো শহরে পৌঁছলে তাকে অর্ধ দীনার ভাতা প্রদান করতে হতো !

ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে তখন বাংলায় দাসপ্রথার প্রচলনের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর মতে, এখনকার খোলা বাজারে পণ্য বিক্রির মত তখন খোলাবাজারে দাস দাসী বেচাকেনা হতো।এ বাজারের দ্রব্যমূল্যের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, উপপত্নী হিসেবে ব্যবহারের যোগ্য এক সুন্দরী তরুণী বাজারে তাঁর সামনে এক স্বর্ণমুদ্রায় বিক্রি হয়েছে। তিনি নিজে প্রায় অনুরূপ মূল্যে আশুরা নামীয় এক যুবতী দাসী ক্রয় করেন।

ইবনে বতুতা তার বিবরনে সে সময়কার বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বর্ণনা করেন।বাংলায় খাদ্যশস্যের এর প্রাচুর্য এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যের সস্তা দর উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, পণ্যের এমন প্রাচুর্য ও সস্তা দর তিনি পৃথিবীর আর কোথাও দেখেন নি। তিনি দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসার প্রসার এবং বাংলার জনগনের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কের বর্ণনাও প্রদান করেছেন। তিনি নদীতে মানুষবাহী ও ব্যবসায়ের পণ্যবাহী অসংখ্য নৌকা চলাচল করতে দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। নদীর তীরে বাজারগুলোর অবস্থানের কথা বর্ণনা করেছেন এবং সোনারগাঁ নদী বন্দরে জাভা অভিমুখে যাত্রার জন্য অপেক্ষমান নোঙ্গর করা একটি বৃহৎ চীনা জাহাজের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এ দেশের ধানচালের ব্যবসায়ের কথাও উল্লেখ করেন। ইবনে বতুতা বলেছেন, নদীতে পণ্য বোঝাই প্রতিটি নৌকায় একটি করে ঢাক রাখা হতো। দু’টি পণ্য বোঝাই নৌকা রাতে পরস্পরের কাছাকাছি এলে নৌকার মাঝিমাল্লারা ঢাক পিটিয়ে পারস্পরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করত। নৌকায় ঢাক বাজানোর এ রীতি সম্ভবত তখন ছিল দেশিয় বাণিজ্য-তরীর পরিচয় শনাক্তকরণের একটি সংকেত এবং নদীতে সম্ভাব্য জলদস্যুতা প্রতিরোধের উপায় হিসেবে ভিনদেশী বা আগন্তক নৌকা চিহ্নিত করণের একটি কৌশল।

ইবনে বতুতা বাংলা ভ্রমণের সময় এ দেশে নিত্য ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রীর বাজার মূল্যের একটি তালিকা তুলে ধরেছেন। পণ্য দ্রব্যের এ মূল্য তালিকা তিনি বাজার সরেজমিন করে তৈর করেছেন। ইবনে বতুতা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছেন দীনার ও দিরহামে এবং পণ্যের ওজন নির্ধারণ করেছেন দিল্লির ‘রতল’ পরিমাপের ভিত্তিতে। ইবন বতুতার বর্ননায় পাওয়া যায় মাত্র এক দিরহাম দিয়ে তখন বাংলাদেশ আটটি স্বাস্থবান মুরগী পাওয়া যেত, এছাড়াও এক দিরহামে পনেরোটা কবুতর, দুই দিরহামে একটি ভেড়া পাওয়া যেত। তবে এখনকার মুদ্রা সাথে তুলনা করে নিন্মরুপ চার্ট পাওয়া যায়।

ইবনে বতুতা
ইবনে বতুতা

চীন
ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যাত্রা করে প্রায় চল্লিশ দিন পর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা উপকূলে পৌছেন। তিনি সেখানকার সূলতান আল-মালিক আজ-জহিররের কাছে প্রায় দুই সপ্তাহ কাটান । এর পরে সূলতান তাকে চীন যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সহ একটি ছোট জাহাজের ব্যবস্থা করে দেন।ইন্দোনেশিয়া থেকে যাত্বরা করে তুতা প্রায় চল্লিশ দিন পরে ১৩৪৫ সালে বর্তমান চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের কুয়ানজু (Quanzhou) বন্দরে পৌছান।

ইবনে বতুতা তার বর্ণনাতে উল্লেখ করেন যে তখনকার কুয়ানজুবাসীরা হুবহু মানুষের প্রতিকৃতি আকতে পারত। সে দেশের সুলতানের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় যখন তিনি স্থানীয় একটি বাজারের ভেতর দিয়ে অতিরক্রম করার সময় এক চিত্রকরের দ্বারা নিজের একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে নেন। সূলতানের সাথে দেখা করে ফেরার পথে তিনি দেখতে পান যে তাঁর এবং তাঁর সাথীদের প্রতিকৃতি শহরের দেয়ালে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। পরে তিনি জানতে পারলেন যে শহরে কোন আগন্তুক আসলেই তার প্রতিকৃতি এভাবে টাঙিয়ে রাখা হয় যাতে করে সেই আগন্তুক কোন অপকর্ম করে পালিয়ে যেতে না পারে।

ইবন বতুতার বর্ণনায় চীনের স্থাপত্য এবং শিল্পকলায় পরিপূর্নতার নিদর্শন পাওয়া যায়। বতুতা চীনের চিত্রকলার অনেক প্রশংসা করেন। কিন্তু চীনের খাদ্যাভ্যাস তাঁর বিন্দুমাত্র উপভোগ্য মনে হয়নি। চীনে অবস্থানকালে তিনি বেইজিংএর গ্রান্ড ক্যানেল, ইয়াজুজ ও মাজুজ অংশে ভ্রমণ করেন। চীনের অনেক প্রশংসা করলেও চীন যে তাকে কোনভাবেই আকর্ষন করতে পারে নি তার বর্ণনা পাওয়া যায় তার উক্তি থেকেই –

কেন যেন চীন নামের দেশটি আমাকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হল। দুঃখ হল এত বিশাল একটি দেশ বিধর্মীদের কবজায় আটকা পড়ে আছে বলে। যখনই আমি বাসার বাইরে যেতাম, খেয়াল করতাম কোনদিকে কোনরকম বিদ্রোহের আভাস পাওয়া যায় কি না, তারপর হতাশ হয়ে ফিরে আসতাম। দরজা বন্ধ করে নিজেকে ভিতরে আটকে রাখতাম। একান্ত প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হতাম না।

অবশেষে ১৩৪৬ সালে তিনি তার দেশ মরক্কো যাওয়ার উদ্দেশে সূলতানের দেওয়া একটি জাহাজে করে কুয়ানজু থেকে পশ্চিম দিকে রওনা দেন।

স্বদেশ মরক্কোতে প্রত্যাবর্তন

কুয়ানজু থেকে তিনি ভারতবর্ষ হয়ে মরোক্কোর পথে রওনা দেন ১৩৪৬ সালে। জাহাজে করে দু মাসে তিনি সুমাত্রা পৌছান। সেখানে দুই মাস অবস্থান করে তিনি কাওলাম (ইতিহাসবিদদের মতে এটা বর্তমান মিয়ানমারের কোন বন্দর) বন্দর হয়ে তিনি ১৩৪৭ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে ভারত পৌছান। ভারতে অবস্থান না করে ফেরার পথে আরো একবার মক্কায় হজ্জ্ব করার চিন্তা করেন ।ভারত থেকে অন্য একটি বাণিজ্যিক জাহাজে চড়ে ভারত মহাসাগর হয়ে তিনি মাসকাটের দিকে যাত্রা করেন। মাসকট থেকে হরমুজ প্রণালী হয়ে সিরাজ, ইস্পাহান হয়ে ১৩৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাগদাদ পৌছান।
১৩৪৮ সালের শুরুতে তিনি সিরিয়ার দামেস্কে আসেন। দামেস্কে স্থানীয় জাহিরিয়া একাডেমিতে তার সাথে মরোক্কোর তাঞ্জিয়ারের এক বিখ্যাত শেখের সাথে দেখা হয়ে যায়।ইবন বতুতা শেখের কাছ থেকে জানতে পারেন যে তার বাবা পনেরো বছর আগে মারা গেছেন তবে তার মা এখনও বেঁচে আছেন।

এ সময় সিরিয়া এবং গাজায় কালা জ্বরের মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। ইবন বতুতা স্থানীয় কাজীর কাছ থেকে তথ্য পানে যে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ২৪০০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বতুতা যখন হেবরন আর গাজা পৌছালেন তখন দেখলেন যে মহামারীর প্রকোপ কিছুটা কমে প্রতিদিন গড়ে ১১০০ তে নেমে এসেছে। এই মহামারী থেকে বাঁচতে ইবন বতুতা প্রতিদিন রোজা রাখতেন। সেখান থেকে কায়রোতে যেয়ে সেখানেও দেখলেন মহামারী থামেনি। ইবন বতুতা কায়রো পৌছানোর আগে এখানে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ২১,০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে জানতে পারেন।কায়রো থেকে মিশরের সাঈদ বন্দর হয়ে ১৩৪৮ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি মক্কা পৌছান। ১৩৪৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত হজ্জ্ব সেরে তিনি ফেজ হয়ে ঐ বছরেই তার নিজ দেশ তাঞ্জিয়ার পৌছান। তাঞ্জিয়ার পৌছে তিনি দেখতে পান যে তার মা ও পরলোক গমন করেছেন।

আল-আন্দুস, স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা ভ্রমণ

ইবনে বতুতা তার নিজের শহর তাঞ্জিয়ারে পৌছে তিনি আসুস্থ হয়ে পড়েন।তিনি প্রায় তিন মাস শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর বতুতা সূলতানের অনুরোধে যুদ্ধে (জিহাদে) অংশগ্রহন করার জন্য রক্ষি বাহিনীতে যোগ দেন এবং সৈন্যবাহিনীর সাথে জাহাজে চড়ে স্পেনের আন্দালুসিয়ায় পৌছান। সে সময় স্পেনের খৃষ্টান শাষক আডফুনাস (Alfonso XI) দশ মাস ধরে জোবেল (জিব্রাল্টার) দখল এবং অবরোধ করে রেখেছিলেন। আডফুনাস মনে করেছিনে যে অবরোধ করে রাখলে হয়তো মুসলিমরা পরাজিত হবে এবং দুর্গের সকলকে একসাথে বন্দি করা যাবে।

কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আডফুনাস নিজেই কালাজ্বরে আক্রান্ত হন এবং পরে মারা যান। আডফুনাস মারা যাওয়ায় মুসলমানদের আর যুদ্ধ করা লাগে নি। ইবনে বতুতা স্পেনের স্পেনের ভ্যালেনসিয়া এবং গ্রানাডা ঘুরে দেখেন।

স্পেনে থেকে স্বদেশে ফিরে ইবন বতুতা আফ্রিকা যাবার মনস্থ করেন। তিনি আফ্রিকার এমন কিছু অঞ্চল পরিদর্শন করার ইচ্ছা পোষন করেন যেগুলো মুসলিম অধ্যুষিত কিন্তু তার এখনও সেগুলোতে যাওয়া হয় নি।তিনি প্রথমে মরক্কো যান যা তখনকার মহামারীতে জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। জনশূন্য হওয়ায় মরক্কোর রাজধানী ফেজ শহরে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

মালি ও সাহারা মরুভূমি

প্রায় সব মুসলিম অঞ্চল ভ্রমণের তার পর আর একটি মাত্র মুসলিম দেশ ভ্রমণ বাকি ছিল, সেটি হল নিগ্রোল্যান্ড। ইবন বতুতা ১৩৫১ সালের বসন্তে সাহারা মরুভুমির উত্তরে সিজিলমাসার উদ্দেশ্যে ফেজ নগরী ত্যাগ করেন। সিজিলমাসাতে তিনি প্রায় চার মাস কাটান। সেখান থেকে ১৩৫২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি লবণের খনির শহর তাঘাজার (Taghaza) উদ্দেশ্যে রওনা দেন। প্রায় পঁচিশ দিনের পথ পারি দিয়ে আঘাজায় পৌঁছান। ইবন বতুতার বিবরণ থেকে জানা যায় সেখানকার ঘরবাড়ি এবং মসজিদগুলো লবণের ব্লক দিয়ে তৈরী আর ছাদগুলো উটের চামড়া দিয়ে তৈরী। এ অঞ্চলে তেমন গাছপালা নেই আর এখানকার পানি ছিল অত্যন্ত লবণাক্ত ছিল।

তাঘাজাতে প্রায় দশদিন অবস্থানের পর ইবন বতুতা সাহারা মরুভূমি পার হবার সিন্ধান্ত নেন। প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তিনি তাসারাহলার একটি মরূদ্যানে তিন দিন অবস্থান করেন এবং মরুভূমি পাড়ি দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত রসদ ও পানি সংগ্রহ করেন। তাসারাহলা থেকে যাত্রা শুরু করে আওয়ালাতায় একবার যাত্রাবিরতি দিয়ে ট্রান্স সাহারান বাণিজ্য রুটের দিকে রওনা দেন। সিজিলমাসা থেকে এই রাস্তায় প্রায় ১৬০০ কিঃমিঃ সাহারা মরুভূমি পার হতে তার প্রায় দুই মাস লাগে। অবশেষে তিনি নাইজার নদীর তীরে মালি রাজ্যে পৌঁছান। তখন সেখানকার সুলতান ছিল মানসা সুলায়মান যিনি কৃপনতার জন্যে কুখ্যাত ছিলেন। তবে এখানকার স্থানীয়দের আতিথিওতা ইবন বতুতার কাছে মনমুগ্ধকর ছিল। ইবন বতুতার বর্ননা মতে মালির লোকজন ধর্মভীরু হলেও এখানকার নারীরা ইসলামী পর্দাপ্রথা মেনে চলত না। তারা সকলেই এমনকি সুলতানের কন্যারাও সকলের সামনে বিবস্ত্র হয়ে চলাফেরা করত।

ইবন বতুতা মালিতে প্রথম জলহস্তির দেখা পান। আট মাস পরে তিনি কাফেলা নিয়ে তিম্বুক্তের দিকে যাত্রা করেন। সেখান থেকে গাঁও শহরে চলে আএন। গাঁও শহরে পৌঁছে তিনি মরক্কোর রাজার ফিরতি আদেশ পত্র পান । পত্র পাওয়া মাত্র তিনি ১৩৫৩ সালের সেপ্টেম্বরে মরক্কোর উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করে করে ১৩৫৪ সালের শুরুর দিকে তার প্রিয় জন্মভূতিতে পৌঁছান।

ইবনে বতুতার গ্রন্থ

মরক্কোর রাজধানী ফেজ এ পৌঁছে ইবন বতুতা সুলতান ও তার সভাসদদের কাছে তার সমস্ত ভ্রমণ কাহিনী বর্ণনা করেন। তার সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইবন খালদুনের মতে সভাসদ বতুতার কথা বিশ্বাস করে নি। তব সভাসদের প্রভাব শালী একজন উজির তার কথা বিশ্বাস করেছিল। সুলতান উজিরের চাপে পড়ে তার একজন একান্ত সচীব ইবন জুজাইকে ইবন বতুতার ভ্রমণ কাহিনী লিখার আদেশ প্রদান করেন। শুরু হল বল ও লিখার পর্ব।

তবে ইবন জুজাই ইবন বতুতার বর্ণনা হুবহু লিপিবন্ধ করেন নি। তার সম্পাদনায় অনেক ক্ষেত্রেই ত্রুটি ছিল । লেখার ধরন সাধারণ কিন্তু তার মধ্যে কিছু স্থানে কবিতার ছত্র যোগ করে লেখায় বৈচিত্র আনতে চেষ্টা করেছেন। কোথাও কোথাও আবার নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথাও জুড়ে দিয়েছেন।

ইবন জুবাইর নামে আন্দালুসিয়ার এক পণ্ডিত দ্বাদশ শতাব্দীতে মিশর, হিজাজ, সিরিয়া এবং পূর্বের বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ইবন বতুতার যে সকল ভ্রমণ পথ ও বর্ণনা ইবন জুবাইরের সাথে মিলে যায় সে জায়গায় ইবন জুজাই নতুন কোন কাহিনী না লিখে ইবন জুবাইরের ভ্রমণের বর্ণনাই তুলে ধরেছেন !

অবশেষে ১৩৫৫ সালের ৯ই ডিসেম্বর মৌখিক বর্ণনা শেষ হলে “রিহলা” নামক বইটি লিপিবদ্ধ করার কাজ শেষ হয়। রিহলা কথাটির সারমর্ম হল “মুসলিম সম্রাজ্য, এর শৌর্য, শহর এবং এর গৌরবান্বিত পথের প্রতি উৎসাহিদের জন্য একটি দান” (A Gift to Those Who Contemplate the Wonders of Cities and the Marvels of traveling” আরবি:”تحفة النظار في غرائب الأمصار وعجائب الأسفار‎ “)। ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনী সম্বলিত এ গ্রন্থের পুরো নাম তুহফাতুন-নুজ্জার ফি গারাইবিল আমসার ওয়া আজাইবিল আস্ফার।

ইবন জুজাই এর মতে ইবন বতুতা নিজেই বলেছেন “আল্লাহর রহমতে সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণের মনঃকামনা পূর্ণ হয়েছে যেটা কোন সাধারণ মনুষের পক্ষে সম্ভব না।” বইয়ের শেষে ইবন জুজাই যোগ করেন

এখানে শেষ হল সফর বর্ণনার, যেটাকে আমি শেখ আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবন বতুতার বয়ান থেকে কিছুটা সংক্ষেপিত করে লিপিবদ্ধ করেছি। যে কোন বোধসম্পন্ন মানুষ সহজেই বুঝবেন তিনি ছিলেন যুগের পরিব্রাজক। যদি কেউ বলেন যে তিনি ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের পরিব্রাজক তাহলে তিনি একটুও বাড়িয়ে না বলার দায়ে অভিযুক্ত হবেন।

এই বইটিকে ১৪শ শতকের পূর্ব, মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৫৮ সালে এ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ বের হয়।