ঘুরে আসুন ঠাকুরগাঁওয়ের ছোট বালিয়া জামে মসজিদ

কোনো এক রাতের আঁধারে মাটিতে নেমে আসে জিন-পরির দল। নানা অলংকরণে নির্মাণ করতে লাগল একটি মসজিদ। সবই হলো কিন্তু ছাদ ও গম্বুজ তৈরির আগেই ভোর হয়ে গেল। দিনের আলোয় জিন-পরিরা থাকে না বলে মসজিদের ছাদ-গম্বুজ তৈরির কাজটিও করা হয় না তাদের। সেদিনের পর জিন-পরিরা আর না আসায় মসজিদের কাজটিও শেষ হয়নি। মসজিদটি সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দাদের কিংবদন্তি এমনই ছিল। তবে কিংবদন্তি যেমনই হোক, ছাদ ও গম্বুজ ছাড়া ১০০ বছর দাঁড়িয়ে থাকার পর জিন-পরির স্পর্শে নয়, মসজিদটি পূর্ণতা পায় স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতেই।

মসজিদটির নাম ছোট বালিয়া জামে মসজিদ। ঠাকুরগাঁও সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ছোট বালিয়া গ্রামে অবস্থিত মসজিদটি। স্থানীয় জমিদার গুলমতি চৌধুরানী এই মসজিদের নির্মাতা। যদিও বিবি গুলমতি চৌধুরানীর নামেই ছিল জমিদারি। কিন্তু কার্যত এলাকা শাসন করতেন তাঁর স্বামী মেহের বক্স। তিনিই মসজিদটি নির্মাণ শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে মসজিদটির সম্ভাব্য বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৮ বছর। মসজিদের গায়ে খোদাই করা তারিখ অনুসারে এটি তৈরি হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে।

মসজিদটি নির্মাণ করার জন্য মেহের বক্স কলকাতা ও দিল্লি থেকে স্থপতি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই সেই স্থপতি মারা গেলে মসজিদের কাজ থেমে যায়। স্থপতি না পেয়ে মেহের বক্স স্থানীয় নির্মাতাদের নিয়ে মসজিদের কাজ আবার শুরু করেন। কিন্তু কাজ শেষ না হতেই ১৯০৫ সালে তিনিও মারা যান। এরপর কয়েকবার চেষ্টা করেও মসজিদটি নির্মাণকাজ শেষ করা যায়নি। সেই থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে এই মসজিদের কাজ কখনো শেষ হওয়ার নয়—এমন কথা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে স্থাপনাটি।

এদিকে অযত্ন-অবহেলায় ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে শুরু করে প্রাচীন স্থাপত্যকলার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সুদৃশ্য মসজিদটি। দেয়ালে জঙ্গল জন্মে ফাটল দেখা দেয়।

স্থানীয় কয়েকজন যুবকের উদ্যোগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বৈজ্ঞানিকসংরক্ষণ পদ্ধতিতে ২০০৯ সালের আগস্টে মসজিদটির পুনর্নির্মাণ শুরু হয়। গাছ, শৈবাল, ছত্রাক, ধুলোয় ঢাকা ভবনটির বিভিন্ন অংশের যথাযথ নথিভুক্তির জন্য আংশিকভাবে ‘শুষ্ক পরিষ্করণ’ (ড্রাই ক্লিনিং) করা হয়।

দেয়ালের ফাটল ও গর্তগুলো পূর্ণ করার জন্য ব্যবহার করা হয় ফ্লুরো সিলিকেট-জাতীয় অজৈব লবণ। এই পদ্ধতি প্রয়োগের আগে দেয়াল ও ভিত্তিতে ঢুকে যাওয়া শিকড় সরানোর জন্য সালফিউরিক অ্যাসিড প্রয়োগ করা হয়। সেই সঙ্গে সাধারণ পানি, ফুটন্ত পানি, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ও পেন্টা ক্লোরো ফেনল ব্যবহার করে ভবনের দেয়ালে জমে থাকা ধুলো, শেওলা, ছত্রাক, লবণ অপসারণ করা হয় বলে প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে।

ছয় মাস মহাযজ্ঞের পর শেষ হয় প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর মসজিদটির পুনর্নির্মাণকাজ। ২০১০ সাল থেকে মুসল্লিরা নামাজ আদায় শুরু করেন। তবে মসজিদটির মূল নকশার কাজ এখনো অসমাপ্ত। সে কাজ এখন এলাকার লোকজনের টাকায় সম্পন্ন হবে।

তিন গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের নির্মাণশৈলী মনোমুগ্ধকর। এর আয়তন পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি। আয়তাকার মসজিদটিকে সিঁড়িসহ প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূল ভবন বা নামাজঘর—তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়।

স্থানীয় বাসিন্দা ও চারুকলার শিল্পী কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, মসজিদটির রং ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির আরও কাজ করা হবে। মসজিদটির ছাদের চারপাশে নির্মাণ করা হবে সুদৃশ্য চারটি মিনার। কাজ সম্পন্ন হলে তখন এর সৌন্দর্য আরও বেড়ে যাবে।

মসজিদ পুনর্নির্মাণ কমিটির সভাপতি আনছারুল হক চৌধুরী বলেন, মসজিদ পুনর্নির্মাণের খরচ গ্রামবাসীসহ এলাকার মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।