২৪ দিনে পায়ে হেঁটে ১০০০ কিঃমিঃ

তাম্মাতের পায়ে হেঁটে ২৪ দিনে ১০০০ কিঃমিঃ ভ্রমণ

কিছু করার ইচ্ছে, অপরিসীম কল্পনা, সবকিছু বদলে দেয়ার ইচ্ছে, এই তিনের যোগসূত্রে তারুণ্য। তাইতো কবি হেলাল হাফিজের অসাধারণ উক্তি, ” এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ট সময় তার “। পায়ে হেঁটে ১০০০কিঃমিঃ পাড়ি দেয়া, তাও আবার ২৪ দিনে শুনলে চোখ কপালে না উঠে পারে না। কিন্তু এই প্রচন্ড মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, বাংলাদেশের দুই প্রান্তে পায়ে হেটে শেষ করলো তম্মাত বিল খয়ের মুন্না।

মানুষকে হাটতে উদ্বুদ্ধ করতে টেকনাফ থেকে পায়ে হেটে তেঁতুলিয়া যাত্রা শুরু করে ছিল সে। গত ১৮ জুন সকাল পৌনে ১০টায় টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ থেকে পায়ে হেটে যাত্রা শুরু করে আজ ১০ জুলাই (মঙ্গলবার) তেঁতুলিয়ায় এসে যাত্রা শেষ করে । সে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাম্মাত গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার কাকডাঙ্গা গ্রামের নিয়ামত আলী শিকদারের ছেলে। তাম্মাত কিন্তু এই প্রথম না, একা পায়ে হেটে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া এর আগে আরিফ নামের এক ভাই ৪১ দিনে শেষ করেন। কিন্তু তাম্মাত আগের সেই রেকর্ডকে ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়লেন। প্রশ্ন একটি থেকেই যায় কেনো এই হাঁটা প্রতিযোগীতা আর এর পিছনের গল্পটাই বা কি?

কান্তজির মন্দির দিনাজপুর
কান্তজির মন্দির দিনাজপুর

সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা :

সময় ১৯৭১, আমার নানা(মোঃ খোলিলুর রহমান খান) ঢাকা সদর ঘাটে এক বইয়ের দোকানে কাজ করতো।
২৫ মার্চ রাত ! নিশ্চই জানেন কি হয়েছিল?
এক কথায় পিছন থেকে হামলা। এমতাবস্থায় নানা প্রায় একদিন ঢাকায় ছিল। পরিস্থিতি ধীরেধীরে হাতের বাহিরে যাচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন অন্য রকম রুপ নিয়েছিল। নানা সিদ্ধান্ত নেন পায়ে হেটে ঢাকা থেকে আমাদের বাড়ি গোপালগঞ্জ যাবেন! তখন কোনো রাস্তা ছিল না।চারদিকে মিলিটারি অত্যাচার চালাচ্ছে।নানা এবং তার চার সঙ্গী মিলে নদীপথে সাঁতার কেঁটে,বনে জঙ্গলে হেঁটে,মিলিটারিদের কে ফাঁকি দিয়ে ৫দিনে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ যায়! আম্মু থেকে এই গল্প শুনে বুঝতে আর বাকি রইলো না কেন আম্মুর পরিশ্রম করতে ভালো লাগে। চিন্তা করে দেখেন তখনের পরিস্থিতি কতটাই না ভয়ানক ছিল। তাও ওনারা নিজেদের অদম্য ইচ্ছার জোরে সফল হয়েছিল।

মূলত এই গল্প শুনেই আমি ভাবি যদি এমন কিছু যদি আমিও করতে পারি তাহলে যুদ্ধের একটা গল্প তরুন সমাজ জানতে পারবে। পাশাপাশি হাটার প্রতি তাদের আন্তরিকতা বাড়বে। গত দুই মাস ধরেই আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলাম। বিভিন্ন ম্যারাথন রানে দৌড়ানোর অভিজ্ঞতা থাকায় আমার মনোবল আরো বেড়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই কায়িক পরিশ্রমের প্রতি একটু বেশি টান আমার। প্রচুর পরিশ্রম হবে,কষ্ট হবে,পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকবে এমন কাজ করে একটু বেশিই মজা পাই। সহজ কথায় বলতে গেলে কষ্ট করতে ভালোবাসি।

এই সফরে আমি প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৪২ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করেছি। বিস্তারিতঃ

বাংলাবান্ধা ০ কিঃমিঃ এ ১০০০কিঃমিঃ হাঁটা শেষ হওয়ার পর
বাংলাবান্ধা ০ কিঃমিঃ এ ১০০০কিঃমিঃ হাঁটা শেষ হওয়ার পর

১। ১ম দিন (শাহপরী দ্বীপ টু শামলাপুর)
দুরুত্বঃ ৪৪.৪ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৯ ঘন্টা ২০ মিনিট

২।২য় দিন (শামলাপুর টু ইনানী)
দুরুত্বঃ ২২.৩ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৬ ঘন্টা ৭ মিনিট

৩।৩য় দিন (ইনানী টু কক্সবাজার)
দুরুত্বঃ ২২.৬ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৫ ঘন্টা ৫৯ মিনিট

৪।৪র্থ দিন (কক্সবাজার টু ডুলাহাজারা)
দুরুত্বঃ ৪৪.৮ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৯ ঘন্টা ৩ মিনিট

৫।৫ম দিন (ডুলাহাজারা টু বাঁশখালী)
দুরুত্বঃ ৪৯.৫ কিঃমিঃ
সময়ঃ ১২ ঘন্টা ১ মিনিট

৬।৬ষ্ঠ দিন (বাঁশখালী টু চট্রগ্রাম)
দুরুত্বঃ ৪২.৫ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৯ ঘন্টা ১৮ মিনিট

৭।৭ম দিন(সম্পূর্ন বিশ্রাম)

৮।৮ম দিন (চট্রগ্রাম টু বড়তাকিয়া)
দুরুত্বঃ ৫৩.৫ কিঃমিঃ
সময়ঃ ১০ ঘন্টা ২৬ মিনিট

৯।৯ম দিন (বড়তাকিয়া টু ফেনী)
দুরুত্বঃ ৪০.১ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৮ ঘন্টা ১৯ মিনিট

১০।১০ম দিন (ফেনী টু কুমিল্লা)
দুরুত্বঃ ৫৯.২ কিঃমিঃ
সময়ঃ ১১ঘন্টা ৫২মিনিট

১১। ১১তম দিন (কুমিল্লা টু দাউদকান্দি)
দুরুত্বঃ৪৯.৮ কিঃমিঃ
সময়ঃ১০ ঘন্টা ১৯ মিনিট

১২।১২তম দিন (দাউদকান্দি টু ঢাকা)
দুরুত্বঃ ৫৬ কিঃমিঃ
সময়ঃ ১১ ঘন্টা ৩৭ মিনিট

১৩।১৩তম দিন (ঢাকা টু জিরানি)
দুরুত্বঃ ৪৩.২ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৮ ঘন্টা ৪৪ মিনিট

১৪।১৪তম দিন (জিরানি টু মির্জাপুর)
দুরুত্বঃ ২৬.৩ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৫ ঘন্টা ৪৪ মিনিট

১৫।১৫তম দিন (মির্জাপুর টু এলেঙ্গা)
দুরুত্বঃ ৩৬.৩ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৭ ঘন্টা ২৯ মিনিট

১৬।১৬তম দিন (এলেঙ্গা টু কুমাজপুর)
দুরুত্বঃ ৪১.২ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৮ ঘন্টা ৬ মিনিট

১৭।১৭তম দিন (কুমাজপুর টু বগুড়া)
দুরুত্বঃ ৫৫ কিঃমিঃ
সময়ঃ ১০ ঘন্টা

১৮।১৮তম দিন (বগুড়া টু জয়পুরহাট)
দুরুত্বঃ ৫২.২ কিঃমিঃ
সময়ঃ ১০ ঘন্টা ১০ মিনিট

১৯।১৯তম দিন (জয়পুরহাট টু ফুলবাড়ি)
দুরুত্বঃ ৫০.৭ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৯ ঘন্টা ৫৮ মিনিট

২০।২০তম দিন (ফুলবাড়ি টু হাবিপ্রবি)
দুরুত্বঃ ৪৯.৭ কিঃমিঃ
সময়ঃ ১০ ঘন্টা ৪ মিনিট

২১।২১তম দিন (হাবিপ্রবি টু ঠাকুরগাঁও)
দুরুত্বঃ ৫৩.৯ কিঃমিঃ
সময়ঃ ১০ ঘন্টা ৩৩ মিনিট

২২।২২তম দিন (ঠাকুরগাঁও টু পঞ্চগড়)
দুরুত্বঃ ৪১.২ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৮ ঘন্টা ১২ মিনিট

২৩।২৩তম দিন (পঞ্চগড় টু তেতুলিয়া)
দুরুত্বঃ ৪০.২ কিঃমিঃ
সময়ঃ ৮ ঘন্টা ২০মিনিট

২৪।২৪তম দিন (তেতুলিয়া টু বাংলাবান্ধা)
দুরুত্বঃ ২৬.৯কিঃমিঃ

এ বিষয়ে আর্থিক সহযোগিতা পেতে আমি বিভিন্ন কম্পানির কাছে যাই। কিন্তু কেউ আমাকে সহযোগিতার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে না। নিজের টিউশুনির টাকা এবং পরিবারের সহযোগিতায় আমি গত ১৮ জুলাই টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ জেটি থেকে হাটা শুরু করি। আমার এই সফরে অনেক মানুষের সহযোগিতা রয়েছে। আমার পরিবার আমাকে প্রতিনিয়ত মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে সহযোগিতা করেছে। সামাজিক গনমাধ্যমে বিভিন্ন বন্ধুবান্ধব, ভাইবোন আমাকে বিভিন্ন জেলা,উপজেলায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মাত্র ৪০০০ টাকা খরচ হয়েছে এই ২৪ দিনের হাঁটা প্রতিযোগীতা শেষ করতে।

যেই জেলাতেই গিয়েছি সেখান কার মানুষের আপ্যায়ন পেয়েছি। তবে তিন জনের কথা বেশি মনে পড়বে। সিরাজগঞ্জ – মামুন ভাই, উনাদের আপ্যায়ন ভুলা সম্ভব না। পুরো গ্রামের মানুষ আমাকে দেখতে আসছে সারাদিন ধরে। খুব মিশুক ওনারা। তেতুলিয়া – হান্নান ভাই,আশরাফুল ভাই। এই মানুষ গুলো বুঝিয়ে দিয়েছে দেশের শেষ প্রান্তে থেকেও পুরো দেশের মানুষের প্রতি এদের আন্তরিকতা কতটা বেশি। ওনারা পুরোদিন আমার সাথে ছিল। যেনো কোনো কিছুর অভাবে না পড়ি। আমার খাবার ঘুম নিয়ে আমার চেয়ে বেশি ওনারা চিন্তিত ছিল।

কি পরিমান ধকল গিয়েছে তা পা দেখলেই বুঝা যায়।
কি পরিমান ধকল গিয়েছে তা পা দেখলেই বুঝা যায়।

যখনি রাস্তায় অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলেছি। নিজের সফর এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছি বলেছি। তখনি তাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা পেয়েছি। যা আমাকে নতুন করে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

প্রথম দিকে পায়ের নিচে পানি জমে যাওয়ার কারনে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয় আমাকে। কিন্তু থেমে যাওয়ার মন মানসিকতা আমার কখনোই ছিল না। পুরো সফরের সেরা মুহূর্ত ছিল বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট। নিজের সফলতা থেকে যখন মাত্র কয়েক মিটার দূরে আমি। আমি এই সফর থেকে অনেক কিছু শিখেছি। নিজের সম্পর্কে জেনেছি অনেক। প্রচন্ড মানসিক ও শারীরিক চাপে নিজেকে ধরে রাখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যা আমার পরবর্তী জীবনে কাজে আসবে বলে আমি মনে করি।

এই সফরের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল মেরিন ড্রাইভে পায়ের নিচে ফোসকা পড়ে গেছিল, প্রচন্ড রোদ আমার হাটতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছিলো। প্রতিটা মিটার আমার কিমি মনে হচ্ছিলো। যার কারনে আমি কক্সবাজারের দিকে দিনে প্রতিদিন তুলনামূলক কম হেটেছি।

তরুন প্রজন্মকে আমি শুধু এতোটুকুই বলবো, আমরা তরুন সমাজ নিজেদের কে সবসময় শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখবো। আমাদের প্রতিদিন অন্তত ২কিমি হাটা উচিৎ। তারুণ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে শরীর সুস্থ রাখতে হবে। তারুণ্যের জয় হোক।