ব্যাকপ্যাকিং ইউরোপ পর্ব : প্রাগ, চেক রিপাবলিক।

আমার একটা অদ্ভুত রোগ আছে, আর তাহলো যেকোনো একটা শহরের প্রেমে পড়ার!

আমার এইবারের প্রেমিকার নাম ‘ প্রাগ’

এই শহরের প্রেমে আমি এখনও পড়েই আছি, এ থেকে মুক্তি নেই। যতবারই পুরনো স্মৃতি মনে করি, প্রেমিকার ছবি দেখি ততবারই যেন প্রেম উথলে উঠে, মনে হয় আবার ছুটে যাই, প্রেমিকাকে দেখে আসি।

প্রেমিকার সাথে পরিচয় ফ্রানয কাফকা নামক একজন লেখকের মাধ্যমে যার মেটামরফসিস নামক একটি বই বহুকাল আগে নীলক্ষেত থেকে কিনেছিলাম। অদ্ভুত সেই বইটি পড়ার পর মনে হলো জীবনে একবার হলেও লেখকের শহরটি দেখে আসবো। অবশেষে সুযোগ আসলো…

চেক রিপাব্লিকের রাজধানি শহর প্রাগ যার মাযখান দিয়ে বয়ে চলেছে শান্ত নদি ভাল্টাভা, ঠিক যেন ছবির মতো। মাঝে মাঝে শান্ত কপোতাক্ষ ভেবে ভুল হয় আমার। কি নেই এই শহরে দেখার মতো। প্রথম দেখায় মনে হবে এই বুঝি রুপকথার গল্পের রাজা তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে হাজির হবে, অথবা মুকুট পরা রাজকন্যা বুঝি তার সঙ্গি সাথিদের নিয়ে বৈকালিক ভ্রমনে বের হবে।
পুরটা শহরের রাস্তায় অলিতে গলিতে খালি ইতিহাসের নানা নিদর্শন। পাথরের তৈরি রাস্তাগুলোতে হাটতে হাটতে একবার নিজেকে নিয়ে যান সেই হাজার বারোশো বছর আগের এই শহরটিতে… আপনি শিহরিত হবেন নিশ্চিত।

অনেক অনেক ঐতিহাসিক যুদ্ধ বিদ্রোহের সাক্ষী এই শহরের প্রধান আকর্ষণ ওল্ড টাউন স্কয়ার যেখানে আছে ঐতিহাসিক প্রাগ এস্ট্রোনোমিকাল ঘড়ি। পনেরো শতকে নির্মিত এই ঘড়ি কিন্তু দিনের সময়ের হিসেব দেয়না, এটি চলে বিষুবরেখার নিয়ম মেনে চাঁদের হিসেবে। এই ঘড়ির হিসেব বুঝা আমার মতো ভেতো বাঙ্গালির কম্ম নয়।

পুরটা শহর জুড়ে আছে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে প্রচলিত বিভিন্ন শিল্পকলার নকশা যুক্ত বিল্ডিং, গোথিক চার্চ, বিখ্যাত চার্লস ব্রিজ, আরো আছে অনেকগুলো যাদুঘর। পুরো শহরটিই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের লিস্টে এখন।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় দূর্গের একটি প্রাগ ক্যাসল। এটি প্রেসিডেন্টের বাসভবন। এর কমপ্লেক্সে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন সেন্ট ভিটাস ক্যাথেড্রালসহ আরও আকর্ষনীয় স্থাপত্য। প্রায় ১০০০ বছর পুরোনো এই ক্যাসেল টি অনেক ইতিহাস বুকে ধারন করে আছে যা লিখলে আপনারা পড়তে গিয়ে বিরক্ত হতে পারেন। পুরো ক্যাসেলটি ঘুরে ফিরে দেখতেই লাগবে পুরোটা দিন।

আরও আছে ভাল্টাভা নদীর উপর ঐতিহাসিক চার্লস ব্রীজ যা যুক্তকরেছে পুরাতন শহর স্টের মেস্টো এবং লেজার টাউন মালা স্ট্রানাকে। রাজা চতুর্থ চার্লস এর নামে এই ব্রিজের নাম চার্লস ব্রিজ। এই ব্রীজটির উপর লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে ৩০টি রেপ্লিকা ভাস্কর্য্য যার প্রত্যেকটি কোন না কোন সেইন্ট এর। এই ভাস্কর্য্যগুলোই ব্রীজটিকে আলাদা করেছে বিশ্বের অন্যসব সেতুর থেকে। ব্রিজের উপর যেন শিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিভিন্ন চিত্রশিল্পিরা। সুনিপুন তাদের সব শিল্পকর্ম মনে হচ্ছে কেউ যেন আধুনিক ডিএসএলআর দিয়ে ছবি তুলে রেখেছে, হাতে আঁকা কোন ছবি নয়।

দেখার মতো আরেকটি যায়গা হলো ড্যান্সিং হাউজ। অদ্ভুত স্থাপত্য নকশার এই বাড়িটিকে ডাকা হয় “Fred and Ginger” খ্যাত কিংবদন্তিনৃত্যশিল্পী ফ্রেড এস্টায়ার এবং জিঞ্জার রজার্স এর নামে। এইখানে দাড়িয়ে অবশ্যই একটি সেলফি তোলাই যায় 😛
প্রাগ গেলে অবশ্যই ট্র্যাডিশনাল ‘কুলাজদা’ (উচ্চারন একটু অন্যরকম কুলায়দা নাকি কি, ভুলে গেছি) খেতে ভুলবেননা। আর যারা দ্রাক্ষা ফলের রস পছন্দ করেন তাদের জন্য প্রাগ হলো স্বর্গ। আমি আর বিস্তারিত বর্ণনায় গেলাম না। তবে আমার জীবনে আমি একটি অপূর্ব সুন্দর রাত কাটিয়েছি স্লোভাকিয়ার একটা ভিনিয়ারড এ। সেই গল্প আরেকদিন।

কিভাবে যাবেন:

খুব সোজা… ঢাকা থেকে বিমানে যেকোনো সেনযেন দেশে (যেটার ভাড়া কম) তারপর সেখান থেকে বাসে অথবা ট্রেনে করে প্রাগ।

থাকা খাওয়াঃ

প্রাগ ইউরোপের মধ্যে তুলনামুলকভাবে ব্যাকপ্যাকারদের জন্য সবচে সস্তা। ওল্ড টাউনের আশে পাশে যেকোনো হোস্টেল পাবেন ৮-১০ ইউরোতে, আর অন্যান্য ডিস্ট্রিক্ট এ আরও কমে পাবেন। ২-৩ ইউরোতে ভরপেট খেতে পারবেন।

চলাচলের জন্য শহর জুড়ে আছে ট্রাম সার্ভিস। ভাড়া খুব একটা বেশিনা আমাদের ঢাকার সাথে তুলনা করলে। তবে যেকোনো ঐতিহাসিক পুরনো শহরে আমি যানবাহনে চড়া থেকে হাটা অথবা সাইকেল চালানো পছন্দ করি বেশি। হেটে হেটে শহর দেখলে পুরোনো শহরের সেই পুরোনো ফ্লেভার পাওয়া যায়।

ভিসাঃ এই বিষয় নিয়ে একটা আলাদা লেখা লিখবো ইনশাল্লাহ।

হ্যাপি ট্রাভেলিং।

লিখেছেন: আব্দুল্লাহ আল মামুন