আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া

আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার বন্দর নগরী দার এস সালামে একদিন

কিলিমানজারো এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম ৮ দিন আগে। সেখান থেকে মোশি, তারপর কিলিমানজারো পর্বতে কেটেছে ৬ দিন। নেমে এসেই টিকেট কাটলাম দার এস সালাম যাওয়ার জন্য। আমার প্রাক্তন বস থাকে মাহমুদ ভাই চাকরি করে তানজানিয়াতে। তানজানিয়া আসবো শুনে পই পই করে বলে দিয়েছে অবশ্যই যাতে দার এস সালাম যাই। না গেলে যে কত বড় ভুল করতাম সেটা যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম। প্রথমে পরিকল্পণা করেছিলাম রাতের বাসেই চলে যাবো। কিন্তু পর্বত থেকে নেমে এসে বুঝলাম অন্তত একদিন পরিপূর্ণ বিশ্রাম নেয়া ছাড়া আমার পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব না। যাকে বলে সর্বাংগে ব্যথা, এরকম শরীর নিয়ে রাতে ভ্রমণের পরিকল্পণা বাদ দিয়ে পরের সকালের টিকেট কেটে নিলাম।

সকাল ৮ টায় নির্ধারিত সময়ে হোটেল থেকে বের হয়ে বাজাজে চড়ে বাস স্টেশনে চলে আসলাম। এই দেশে সিএনজিকে বলে বাজাজ। আরুশা থেকে ছেড়ে আসা আমার বাসের নাম কিলিমানজারো এক্সপ্রেস। তানজানিয়ার গর্ব এই পর্বত। আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ এই পর্বতের নামেই অনেক কিছুর নামকরণ করা। বেশ বড়সড় আরামদায়ক বাস, তবে দুই সিটের মাঝখানে পা রাখার জায়গাটা একটু কম। আফ্রিকার দৃশ্য দেখতে দেখতে ৯ ঘন্টা পরে এসে পৌছালাম বন্দরনগরী দার এস সালামে। বাস স্ট্যান্ডেই আমার বস আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। দুজনে মিলে রওনা দিলাম বাসার দিকে, বাসায় পৌছে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ার আগে মাহমুদ ভাই জানিয়ে গেল তার দুবাচ্চার কাল সকালে স্কুলের পিকনিক, তাই সকালে তাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়বো শহর দেখার জন্য।

এত রাস্তা বাসে করে এসে বেশ ক্লান্ত। তার উপর প্রায় ২০ দিন পরে দেশের রান্না ভরপেট খেয়ে আমার দুচোখ ভেংগে ঘুম আসছিলো। ১০ টা বাজেই শুয়ে পড়লাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম দার এস সালামের কথা। ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞান বইয়ে পড়েছিলাম তানজানিয়ার রাজধানী দার এস সালাম, কিন্তু এখানে এসে জানলাম ভিন্ন কথা, ওদের বর্তমান রাজধানী দোদোমা। তবে পূর্বের রাজধানী দার এস সালামই এখনও প্রাশাসনিক রাজধানী। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা, খুব ভোরে অন্তত কর্কশ একটা পাখির ডাকে ঘুম ভাংগলো। ভোর ৬ টা বাজে এরকম ভয়াবহ আওয়াজ করছে কোন পাখি সেটা বোঝার চেষ্টার করছিলাম বারান্দায় যেয়ে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার একটু পরে মাহমুদ ভাই আসলো খবর নিতে। জানালাম ঘুম ভালোই হয়েছে তবে ভয়াবহ একটা পাখির ডাকে এই ভোরে ঘুম ভাংগলো। মাহমুদ ভাই হেসে বললো এটা ময়ূরের ডাক, এখানে প্রচুর ময়ূর আছে, সকাল বেলা তারা এক সাথে হাকডাক করে। মানতে কষ্ট হচ্ছিল এত সুন্দর একটি পাখির গলা এরকম কর্কশ, বারান্দায় যেয়ে এবার ভালো করে দেখতেই কালপ্রিটদের খুজে পেলাম।

সকালে উঠেছি অবশ্য ভালোই হয়েছে, আজ রাতেই আমার ফ্লাইট। তাই সময় নষ্ট না করে যতটা সম্ভব ঘুরে দেখা দরকার। ভাবী ইতিমধ্যে বাচ্চাদেরকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেয়ার পর স্কুলে তাদেরকে রেখে আমরা তিনজন ঘুরতে বের হয়ে গেলাম। প্রথম গন্তব্য মাছের বাজার কিভুকুনি। সমুদ্রের কাছে এ বাজারটা বেশ জমজমাট। বিভিন্ন জায়গা থেকে মাছ এসে এখানেই নামে, হাক ডাক দিয়ে মাছ বিক্রি হচ্ছে বেশ। তার পাশেই ভারত মহাসাগরের একটি প্রান্ত। জানজিবারের ফেরীগুলো উল্টো পাশের ফেরীঘাট থেকে ছেড়ে যায়। আমরা যখন পৌছেছি তখনই ছেড়ে গেল একটি ফেরী, যেটার নামও পর্বতের নামে, কিলিমানজারো ৪। সমুদ্র থেকে আসা বিভিন্ন মাছ দেখে এক পাশে যেয়ে দেখলাম মাছ ভাজিও বিক্রি হচ্ছে। সেখান থেকে ছোটমাছের ফ্রাই কিনে খেয়ে চলে এলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সেন্ট জোসেফ চার্চে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শহর দার এস সালাম। ছুটির দিন বলে রাস্তা প্রায় খালি। চার্চ ঘুরে দেখে চলে গেলাম স্লিপওয়েতে।

স্লিপওয়ে জায়গাটা বেশ জমজমাট। পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে এখানে। অসম্ভব সুন্দর ভারত মহাসাগরের নীল জলরাশির পাশে এ জায়গাটা মূলত রেস্তোরা আর শপিংয়ের জন্য বিখ্যাত। বাচ্চাদের খেলার জায়গায়ও আছে। পানি এত সুন্দর আর স্বচ্ছ, ইচ্ছে করছিলো যেয়ে ডুব দেই। খোজ নিয়ে দেখলাম ডাইভিং ও স্নোরকেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে, তবে সেটার জন্য সকাল সকাল আসতে হয়। ইতিমধ্যে দুপুর হয়ে গেছে। একটা সমুদ্রতীরের একটা রেস্তোরায় বসে আমরা দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম। তিনজন তিন রকমের সি-ফুড অর্ডার দিলাম, যাতে করে আসলে পরে ভাগ-যোগ করে খাওয়া যায়। সুস্বাদু সেই খাবার শেষ করে কিছুক্ষণের বিরতি দেবার জন্য বাসায় ফিরে গেলাম আমরা।
এর মধ্যে বাচ্চারাও চলে আসলে বিকেলে আমরা গেলাম কোকো বীচে। সৈকতজুড়ে অনেক নারিকেল গাছের কারণে এ বীচের নাম হয়েছে কোকো বীচ। ভালো একটা বসার জায়গা খুজে বের করলাম, এর মধ্যে এক ধরণের বিশেষ কাবাব পাওয়া যায় সেখানে, মাহমুদ ভাই সেটার অর্ডার দিয়ে দিল।

আমি নেমে পড়লাম পানিতে, ভারত মহাসাগরের পানিতে না নামলে আর হচ্ছিলনা। পানিতে কিছুক্ষণ ডোবাডুবি করে উঠে সুস্বাদু কাবাব খেয়ে চলে গেলাম শপিং করতে। বলতে ভুলে গেছি দার এস সালাম নামার পর এখনও মানিব্যাগে হাত দিতে পারিনি। মাহমুদ ভাই কিছুতেই সেটা করতে দিলেন না। উল্টো ছেলে আর বৌয়ের জন্য আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহি জামা কিনে দিলেন।
রাতেই আমার ফ্লাইট। মনে মনে আফশোসের শেষ নেই। একটা সপ্তাহ ছুটি নিতে পারলে জানজিবারও যাওয়া যেত। এছাড়া আফ্রিকার সাফারিটাও সেরা। ভবিষ্যতে আবার কোনদিন যদি আসতে পারি তাহলে অন্তত জানজিবার আর সাফারিটা মিস করবোনা। আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। কোন ট্যুরিস্ট বা স্থানীয় কাউকেই যত্র তত্র ময়লা ফেলতে দেখেনি, আমিও সেটা করিনি।