কুঞ্জ, পেরিমোহন আর বঙ্কু সাহার জমিদার বাড়ির কথিকা

লিখেছেন : মাদিহা মৌ

নরসিংদীর ডাঙ্গায় লক্ষ্মণ সাহার জমিদার বাড়ি পাশেই কুঞ্জ সাহার জমিদার বাড়ি। দুটি বাড়ি একেবারে পাশাপাশি। এখানে আসার আগে শুনেছিলাম, এই এক গ্রামে তিন তিনটে জমিদার বাড়ি আছে। লক্ষ্মণ সাহার জমিদার বাড়ি ঘুরে অন্য দুটো বাড়িতে যাব, কিন্তু রাস্তা তো চিনি না। বৃদ্ধ একজন লোক লক্ষ্মণ সাহার বাড়ির উঠোন পেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে না আরেকটা জমিদার বাড়ি আছে? ওটা কোন দিকে?’
উনি মাথা ঝাঁকিয়ে পুকুরপাড়ের রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখান দিয়া দুইমিনিট হাঁইটা গেলেই পাইবা।’

দুইমিনিট হাঁটতেই আরেকটা পুকুর পেলাম। এই জমিদারবাড়িটি রাস্তা থেকে একটু ভিতরের দিকে। তবুও রাস্তার ডান পাশে গাছগাছালির ফাঁক গলে উঁকি দিয়ে জানান দিলো, আমি এখনো স্বদর্পে দাঁড়িয়ে আছি!
লক্ষ্মণ সাহার বাড়িটির মতো এই বাড়ির উঠোনের একধারে বর্গাকার একটি মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। আকারে লক্ষ্মণ সাহার বাড়ির মন্দিরের মতোনই, এটাতেও কারুকাজ করা আছে। তবে এই মন্দিরের কারুকাজ লক্ষ্মণ সাহার বাড়ির মন্দিরের মতো নজরকাড়া নয়।

বাড়িটি একতলা। অনেকগুলো ঘর আছে। প্রায় সবগুলো ঘরেই লোকজন বসবাস করে। বাড়িটিও এর মন্দিরের মতোই। দেয়াল আর প্রবেশদ্বারগুলোর উপরে হালকা কারুকাজ করা। লক্ষ্মণ সাহার বাড়ির মতো এটি সুনসান নিরব নয়। বাড়ির উঠোন থেকে একটু সামনে অন্য একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ চলছে। মিস্ত্রিরা খুটখাট শব্দে কাজ করে যাচ্ছে।

এই শব্দে জমিদার বাড়ির প্রাচীনত্বের আবহ বিঘ্নিত হলেও, এতে বিন্দুমাত্র বিরকত নয় মন্দিরের কারুকাজের উপর বসে থাকা একদম সাদা আর কালো কবুতরগুলো। তারা পালকের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে ধ্যান করছে নিজেদের মতো করে।

যেহেতু লোকজন থাকে, তাই আর উপরে ওঠার চেষ্টা করলাম না। ওখান থেকে বেরিয়ে এসে পুকুরের দিকে নজর দিলাম। এই পুকুরটির ঘাট শান বাঁধানো। কিন্তু ভেঙ্গে গেছে জায়গায় জায়গায় পুকুরের পানি একদম টলটলে।

লক্ষ্মণ সাহার জমিদার বাড়ি দেখার সময় কিছু জিনিস খেয়াল করিনি। দুই বাড়ির সামনে দুটো পুকুর। পুকুর দুটির অপর পাড়ের কোণায় দুটি ছোট আকৃতির মঠ দাঁড়িয়ে আছে। কুঞ্জ সাহার বাড়ির সামনের মঠের নিচের অংশ ভেঙে গেছে। ভাঙা চুন-সুরকি আর সেকালের পোড়া ইটের উপর কোনোমতে উপরের অংশটুকু কাঁত হয়ে টিকে আছে। একটুখানি ভূমিকম্প হলেই হয়তো ধ্বসে পড়বে।

কুঞ্জ সাহার পুকুরপাড়ের ওই একই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে লক্ষ্মণ সাহার পুকুরের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা মঠটি। ছোটোর মধ্যে এতো সুন্দর! দোতলার অংশটুকুতে জমিদার বাড়ির মতোই কী সুন্দর জানালার অবয়ব বানিয়েছে। এখান থেকে চলে যাবার সময় আরেকজন লোকের সাথে আলাপ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এই মঠ দুটো হলো লক্ষ্মণ সাহা এবং পেরিমোহন সাহার শ্মশান। অদ্ভুত, তাই না? মরে যাওয়ার পরেও আভিজাত্যকে ছেড়ে যায়নি। তাই শ্মশানের আকৃতিতেও নিজের বাড়ির অবয়ব ধরে রাখতে চেয়েছে।

“পেরিমোহন সাহা” নামটা শুনে নিশ্চয়ই যেহেতু অবাক হয়েছেন? কথা তো হচ্ছিল, লক্ষ্মণ সাহা আর কুঞ্জ সাহা নিয়ে। পেরিমোহন সাহা এলো কোত্থেকে? আমিও অবাক হয়েছিলাম, স্থানীয় লোকজন লক্ষ্মণ সাহার জমিদার বাড়ির পাশের বাড়িটির নাম একেকজন একেকটা বলছে বলে। ইতিহাস ঘেটে আমি একটি হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছি। আমি আমার মতো সেটা ব্যাখ্যা করে বলছি।

জমিদার লক্ষ্মণ সাহার ছিলো তিন ছেলে। নিকুঞ্জ সাহা, পেরিমোহন সাহা ও বঙ্কু সাহা। জমিদার মারা যাওয়ার পর তারা তিন ভাই এই সম্পত্তি দেখভাল করতেন। বঙ্কু সাহা ভারত ভাগের সময় এখান থেকে ভারতে চলে যায়। বাংলাদেশে থেকে যায় দুই ভাই। পাকিস্থান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়ার কিছু পূর্বে নিকুঞ্জ সাহাও ভারতে চলে যায়। তখন থেকে যায় পেরিমোহন সাহা। এই পেরিমোহন সাহার ছিলো এক ছেলে। তার নাম বৌদ্ধ নারায়ন সাহা। লক্ষ্মণ সাহার বংশধরের একাংশ বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ শহরে বসবাস করছে।

এইটুকু হলো ইতিহাস। যেহেতু লক্ষ্মণ সাহার বাড়ি নিয়ে কারোর কোনো দ্বিমত নেই, দ্বিমত কেবল পাশের বাড়িটি নিয়ে। ধরা যাক, লক্ষ্মণ সাহার নিজের বাড়ি হলো প্রথম বাড়িটি। তিনি তার ছেলেদের জন্য পাশের বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। যেহেতু ছেলেদের নাম নিকুঞ্জ ও পেরিমোহন, তাই একেকজন একেক ছেলের নামে ডাকে। এই দুটো জমিদার বাড়ির মাঝখানে সেকালের স্থাপত্যকলায় একটি অর্ধনির্মিত বাড়ি আছে। কোনো কারণে হয়তো বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি। এই অর্ধনির্মিত বাড়িটি থেকেও যেন আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে।

এই জমিদারি সম্পর্কে কিছু অভিনব তথ্য পেলাম। তৎকালীন ভারতবর্ষে এই এলাকাটি ছিল দেবোত্তর হিসেবে। মূলত দেবোত্তর বলতে বুঝায় ওয়াকফাহ্ জমি। ঐ সময়ে দেবোত্তর জমি হলে জমিদারকে খাজনা দেওয়া লাগতো না। জমিদার লক্ষ্মণ সাহা ছিলেন মূলত প্রধান জমিদারের অধিনস্থ সাব-জমিদার।
সাব জমিদারের খাজনা দেওয়া লাগতো না, তার উপরে আবার এমন আভিজাতিক বাড়িও বানাতে পেরেছে লক্ষ্মণ সাহা! তাহলে তো দেখছি, প্রধান জমিদার হওয়ার চেয়ে সাব জমিদার হওয়াই বেশি ভালো।

মঠটির পিছনে একটি ডোবামতোন জায়গায় অজস্র বেগুনি রঙের কচুরিপানা ফুল ফুটে আছে।
এখান থেকে লক্ষ্মণ সাহার বাড়ি আর অর্ধনির্মিত বাড়িটি একসাথে দৃষ্টিগোচর হয়। গ্রামবাংলার প্রকৃতির সাথে এই প্রাচীনতা যেন চমৎকারভাবে মিশে গেছে।

কীভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে ডাঙ্গা আসার তিনটি রাস্তা আছে।

ঢাকা গুলিস্তান থেকে আসতে হলে গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদপুলিশ বক্সের সামনে থেকে মেঘালয়লাক্সারী, মেঘালয়,বিআরটিসি, সোহাগ বাসে পাঁচদোনা। বাসে মাধবদীর টিকিটকাটবেন। মূলত মাধবদীর টিকিটে আপনিপাঁচদোনা মোড় নামতে পারবেন। অবশ্যই বাসসুপারভাইজারকে বলে রাখবেন যেনপাঁচদোনা মোড় নামায়।

পাঁচদোনামোড় নেমে যে কাউকে বললেই আপনাকেডাঙ্গা সিএনজি স্ট্যান্ড দেখিয়ে দিবে।এক সিএনজিতে সর্বোচ্চ পাঁচ জন। ভাড়ানিবে জনপ্রতি ৪০ টাকা। ডাংগা
পৌঁছাতে সময় লাগবে ৪০-৪৫ মিনিট।

মহাখালী বনানী উত্তরা থেকে কুড়িল বিশ্বরোডহয়ে ৩০০ ফিট দিয়ে কাঞ্চন ব্রিজ পেরিয়েই মায়ার বাড়ি মোড়ে নামবেন।
মোড়েই ডাঙ্গা আসার জন্যে চার্জের
অটোগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। জন প্রতি ভাড়াদিয়ে অথবা রিজার্ভ ও নিয়ে আসতে পারবেন।

টংগী ও আবদুল্লাহপুর থেকে আসবেন
তারা সরাসরি বাসে অথবা লেগুনায়
কালিগঞ্জ চলে আসবেন। কালিগঞ্জ নদীর
ঘাটে এসে নৌকায় নদী পার হয়ে এই পাড়
আসবেন। না চিনলে কাউকে জিজ্ঞেস করেনেবেন যে ডাঙ্গা যেতে কোন ঘাট দিয়ে পার হবেন। নদী পেরিয়ে ডাঙ্গা আসারসরাসরি রিক্সা,অটো ও সিএনজি পাবেন।ঘাট থেকে ডাঙ্গা বাজার মাত্র ৪-৫কিলোমিটার।

ডাঙ্গা বাজার নেমে রিক্সায় যেতে পারবেন উকিলের জমিদারবাড়িতে। ডাঙ্গা বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরত্ব। ভাড়া ২০ টাকা। সমস্যা হলে কাউকেজিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন। লক্ষ্মণ সাহার বাড়ি থেকে দুই মিনিট দূরত্বে। ডাঙ্গায় এলে একই জায়গায় তিনটি জমিদার বাড়ি দেখতে পারবেন।

যেখানেই বেড়াতে যান, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখুন।

লিখেছেন : মাদিহা মৌ