আমার ট্রাভেল ভিসা বিষয়ক জ্ঞান

বিদেশ ভ্রমণে আমাদের সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় হল ভিসা। এই সবুজ রঙের বাংলাদেশি পাসপোর্টের প্রতি যেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ভিসা অফিস আর ইমিগ্রেশন এর একটু চুলকানি আছে, ভিসা দিতে দুনিয়ার ডকুমেন্ট দেওয়া লাগে, তারপরও ভিসা অনিশ্চিত। আর ভিসা পাওয়ার পর ভ্রমন কালে ইমিগ্রেশনে গেলে অফিসার এমনভাবে পাসপোর্টের দিকে তাকিয়ে আপনার দিকে তাকাবে মনে হবে যেন ইমিগ্রেশন অফিসার ভাবতেসে আপনি এইমাত্র প্লাস্টিক সার্জারি করে আসছেন!
এসবের অবশ্যই কিছু কারন আছে যেটা এখানে আলোচনা করছি না।

প্রথমেই ডিস্ক্লেইমার দেই। ভিসা নিয়ে আমি যা লিখবো সেইটা আমার সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে। আমি অথবা আমার চৌদ্দগুষ্ঠির কেউ কোন ট্রাভেল এজেন্সি অথবা ট্যুর কোম্পানির অথবা ভিসা এজেন্টের সাথে জড়িত না এবং আমি এধরনের তেমন কাউকে চিনিওনা। আর যারা শুধুমাত্র ভ্রমনের উদ্দেশে বিদেশ যেতে চান তাদের জন্য এই লেখা।

অমুক দেশের ভিসা আমি কিভাবে পাইতে পারি। এই একটি খুব কমন প্রশ্ন যাদের একটু আধটু বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান থাকে।

প্রথমে ভিসা টাইপ নিয়ে বলি। ভ্রমণের জন্য সাধারনত ভিসিট ভিসা অথবা ট্রাভেল ভিসা দরকার। আবার অনেকে অফিসিয়াল কাজে গিয়েও একটু সময় করে ঘুরে আসেন। সেই ক্ষেত্রে তাদের ইনভাইটেশন দরকার হয় যেইটা অফিস ম্যানেজ করে দেয়।

এইবার বলি ডকুমেন্টেশন নিয়ে। প্রত্যেকটা এমব্যাসিরই ওয়েবসাইট আছে যেখানে খুব ডিটেইলস বলা থাকে টুরিস্ট ভিসার জন্য কি কি ডকুমেন্ট দরকার হয়। এজন্য আপনাকে কখনই কোনো এজেন্টের কাছে যেতে হবেনা। Google নামক একটা কিছু আছে যেখানে আপনি এমব্যাসির ওয়েবসাইটের ঠিকানা পাবেন আর সেইখান থেকে পাবেন দরকারি ডকুমেন্টের লিস্ট। সেই চেক লিস্ট অনুযায়ী ডকুমেন্টগুলো জোগাড় করতে হবে। সবার আগে ভিসা এপ্লিকেশন পুরন করতে হবে যেইটা এমব্যাসির ওয়েবসাইটেই সাধারনত পাওয়া যায়। একটু কষ্ট করে ডাইনলোড করে নিতে হবে। এইসবক্ষেত্রে সব সময় সঠিক তথ্য দিবেন। কোনো রকম ভুল ইনফরমেশন দেওয়া ঠিক হবেনা। যা যা জানতে চায় শুধু তাই লিখুন, কোনো রকম অতিরঞ্জিত করার দরকার নেই। সব এমব্যাসিই ফিনান্সিয়াল প্রুফ চায়। মিনিমাম ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট চায়। তার মানে এই নয় যে ব্যাংক এ থাকতে হবে আপনার কাড়ি কাড়ি টাকা। সহজ যেই ভুলটা আমরা করি সেইটা হলো ডকুমেন্ট এমব্যাসি তে জমা দেওয়ার কয়েকদিন আগে কিছু টাকা জমা রাখি আর পাসপোর্ট জমা দেওয়ার কয়েকদিন পর উঠায় নিই। আমার মনে হয় এইটা একটা ভুল স্ট্রেটেজি। আপনার ভ্রমন প্ল্যান যখন করবেন তখন থেকেই কিছু টাকা জমা রাখবেন। এমব্যাসি যেটা দেখতে চায় সেটা হলো টাকার স্থিতি, হটাত করে অনেক টাকা একাউন্টে জমা পরবে অথচ ছয় মাস টাইমের মধ্যে তেমন কোন স্থিতি/ট্রাঞ্জেকশন নাই এইটা মনে হয় ভাল ভাবে দেখেনা এমব্যাসির ভিসা অফিসাররা।

ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে যেইটা সবচেয়ে গুরুত্তপুরন তা হলো এমব্যাসি অবশ্যই ভিসা আবেদনকারীর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে দেখবে। তারা দেখে যে ভিসা আবেদনকারি তার ভ্রমন শেষে নিজ দেশে ফেরত আসবে কিনা অর্থাৎ নিজ দেশে ফেরত আসার যথেষ্ট কারন আছে কিনা এবং তার ভ্রমন করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা তার আছে কিনা। সেই ব্যাকগ্রাউন্ডই এমব্যাসি চেক করবেই, হতে পারে যেকোনো থার্ড পার্টির মাধ্যমে করবে এই কাজ।

এইটা মোটামুটি সকল এমব্যাসির জন্য প্রযোজ্য।
এমব্যাসির নিরধারিত দরকারি ডকুমেন্টস আর ভিসা অ্যাপ্লিকেশন ফী সহ এমব্যাসি তে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিয়ে এইবার অপেক্ষার পালা। পাসপোর্ট জমা দেওয়ার সময় এমব্যাসি থেকে একটা পাসপোর্ট ডেলিভারি ডেট দিবে। সেই ডেইটে গিয়ে পাসপোর্ট ফেরত আনতে হবে।

সেনজেন ভিসার জন্য ও একই নিয়ম। প্রয়োজনীয় চেক লিস্ট অনুযায়ী ডকুমেন্ট নিয়ে ভিসা ফী সহ এমব্যাসিতে জমা দিতে হবে। তবে কিছু কিছু এমব্যাসি সরাসরি ডকুমেন্ট রিসিভ না করে তাদের এজেন্ট VFS এর মাধ্যমে জমা নেয়। সেই ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠান একটা নির্ধারিত ফী নিবে আর সাথে যোগ হবে এমব্যাসির নির্ধারিত ফী। সবকিছু সহ নিজে গিয়ে জমা দিয়ে আসতে হবে। আর যেসব এমব্যাসি নিজেরা সরাসরি ডকুমেন্ট জমা নেয় সেইসব ক্ষেত্রে ওরা একটা ইন্টারভিউ নেয়। সাধারন প্রশ্ন করে যেমন আপনি কি করেন, কেন যাবেন, কোথায় যাবেন, কই থাকবেন, কবে ফিরবেন, এইসব প্রশ্ন। উত্তর দিতে হবে খুব কনফিডেন্টলি। এবং কোনোরকম অতিরঞ্জিত বা অতিরিক্ত কথা বলা ঠিক হবেনা। আর যাবতীয় ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার সময় অবশ্যই একটা ফরওয়ার্ডিং লেটার দিবেন যাতে আপনার পরিচয় দিয়ে আপনার যাওয়ার কারন এবং আপনার ভ্রমনের বিস্তারিত প্ল্যান বলে ভিসা প্রদানের জন্য অনুরোধ করবেন। চিঠিটি লিখবেন এমব্যাসির ভিসা অফিসার বরাবর।

আমেরিকার ভিসার জন্য নির্ধারিত এজেন্ট ছিলো সাইমন সেন্টার। এখন আর নেই আগের অবস্থা। কমেনট এ একজন বিস্তারিত লিখেছেন। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস, নির্ধারিত পুরন করা ফর্ম, এমব্যাসি ফী সহ জমা দেওয়ার পর একটা ইন্টারভিউ তারিখ দিবে। সেই তারিখে গিয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে আসতে হবে। সেইখানেও একই রকম প্রশ্ন… কি করেন, কই যাবেন, কেন যাবেন, কয়দিন থাকবেন, কোথায় থাকবেন এসব। প্রশ্নের উত্তর কনফিডেন্টলি দিতে পারলে ভিসা না দেওয়ার কারন নাই। তবে ওরা মনেহয় কোনো থার্ড পার্টি দিয়ে ইন্টারভিউ এর আগেই ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে নেয়। আমেরিকার ক্ষেত্রে ভিসা বেপারটা একটু রহস্য জনক। সব কিছু ঠিক থাকার পর ও তারা ভিসা না দিতে পারে যার কোন ব্যাখ্যা যোগ্য কারন নাই।

কিছু কিছু দেশের টুরিস্ট ভিসার জন্য আবার ইনভাইটেশন লাগে ওই দেশের কোন এজেন্সি থেকে। সেই ক্ষেত্রে আমাদের দেশের এজেন্সিগুলার হেল্প নিতে হবে। এজন্য দেশি এজেন্সি গুলা চার্জ নিবে। সবসময়ের জন্য গলাকাটা একটা চার্জ তারা নেয়। দেশি এজেন্সি গুলারে দেখলে মনে হয় রামদা নিয়ে বসে আছে, গেলেই দিবে একটা কোপ! অতিরিক্ত চার্জ নেয় যার কোন লিমিট নাই, যার থেকে যা পারে।

আমার একটা বেক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। গত মাসে ফিলিপাইন গিয়েছিলাম। ভিসার জন্য যখন অমুক তমুক বিভিন্ন এজেন্সিতে ফোন দিলাম তখন তারা ৭-১২ হাজার টাকা চাইলো। অথছ এমব্যাসির নির্ধারিত ফী মাত্র ৩৬০০ টাকা। পরে আমি ৪১০০ টাকায় এমব্যাসি নির্ধারিত এজেন্টের মাধ্যমে ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিসি। এই হইলো অবস্থা!
তাই বলি সবসময় আগে নিজে একটু ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করুন, এমব্যাসির ওয়েবসাইটে দেখুন। তারতপর সিদ্ধান্ত নিন এজেন্সির কাছে যাবেন কিনা।

কিছু কিছু দেশের আবার আমাদের দেশে এমব্যাসি অথবা হাইকমিশন নাই। সেই ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তি দেশ ভারতে ডকুমেন্ট পাঠাতে হয়। এসব ক্ষেত্রে এজেন্সির সাহায্য দরকার হয়, কারন পাসপোর্ট দিয়ে আসা আবার ফেরত আনার হ্যাপা অনেক। বাজার যাচাই বাছাই করে কম খরছ যেখানে পাবেন সেখানে যাবেন। এসবক্ষেত্রে মনে রাখবেন, কেউ আপনাকে যদি ভিসার নিশ্চয়তা শতভাগ ধরে নিবেন সে একটা প্রথম শ্রেনির ভন্ড।
এই হইলো আমার ভিসা বিষয়ক জ্ঞান।

হ্যাপি ট্রাভেলিং!

লিখেছেন: আব্দুল্লাহ আল মামুন