ইচ্ছেপূরণ লিষ্টের প্যাডেল স্টিমারে চড়ার অভিজ্ঞতা

এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম জার্নি অথচ এদেশের সবচে উপভোগ্য ভ্রমণও কিন্তু এটি। এদেশে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে চলা আর কোন প্যাসেঞ্জার ট্রান্সপোর্টের টানা ২৭ ঘন্টা রানিং টাইম নাই। অথচ প্যাডেল স্টিমারে চেপে ঢাকা থেকে খুলনা যেতে সময় লাগে ঝাড়া ২৭ ঘন্টা। এই ভ্রমণে দেখবেন দক্ষিণ বাংলার মানুষ ও প্রকৃতি, তাদের নদীকেন্দ্রিক জীবন আর দেখবেন নদী। এই ভ্রমণে আপনি ছুয়ে যাবেন বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, মেঘনা, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, বিষখালী, গাবখান, সন্ধ্যা, কচা, বলেশ্বর, মংলা, পশুর ও রুপসা নামের নদীগুলোকে। পাশ কাটাবেন বা ছুঁয়ে যাবেন অনেকগুলো জেলা। এক ভ্রমণে এত নদী আর জেলা দেখার সুযোগ আর কোন ভ্রমণে আছে কি?

ছবিতে যেমনটা দেখছেন ঘুম ভেঙ্গে ব্রীজে এসে দেখি স্টিমারের এসি কেবিনের শৈত্যের চেয়ে বাইরের শৈত্য বরং বেশি আরামদায়ক। যাত্রী এমনিতেও ছিলোনা, আর যা ছিলো বরিশালে তাও নেমে গেছে। যদি থাকতোও এসি কেবিনের প্রথম শ্রেণীতে তার কোন প্রভাব পড়তোনা। স্টিমার এগুচ্ছিলো গাবখান চ্যানেলের জল কেটে। সামনে ধূসর একটা সেতু, বিটিভি যুগে এটা উদ্ভোধনের সময় বার বার বলছিলো দেশের উচ্চতম সেতু। ক’বছর আগে এটার উপর নিয়ে গিয়েছিলাম, আজ যাচ্ছি নিচ দিয়ে। দুপাশের গ্রাম তখনো আধোঘুমে, কুয়াশারর চাদর গায়ে আড়মোড়া ভাঙ্গছে নতুন একটা দিন। এত চমৎকার ভোর খুব কমই এসেছে আমার জীবনে।

জার্নিটা বোরিং হবে ভাবছেন? উপযুক্ত সঙ্গী পাশে থাকলে (যার সঙ্গী নাই তার পাশে থাকতে পারে উপযুক্ত বই) বা একাকী কোনভাবেই এই জার্নি আপনাকে বোরড করবেনা। প্রথমবার চড়ার পরেই আমি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর থেকে অপ্রয়োজনেই বার বার ছুটে যাই স্ট্রেস ঝাড়তে। আমার বিশ্বাস আপনিও যাবেন।

প্রায় শত বছরের পুরোনো সরকারী রকেট সার্ভিসের আওতায় এখনো চারটি স্টিমার চলছে পাবলিক টান্সপোর্ট হিসেবে যা আর পৃথিবীর কোথাও এভাবে চলছেনা। লেপচা, টার্ণ, অস্ট্রিচ ও মাসহুদ নামের ঐতিহ্যবাহী নৌযানগুলোতে নিরাপদ নৌ ভ্রমনের সাথে সুস্বাদু খাবার ও চমৎকার সার্ভিস পাওয়া যায় যা এক বিরল অভিজ্ঞতা। রানী এলিজাবেথ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী কে চড়েননি এই নৌযানে? স্টিমারের খাবার মনে ধরেছিলো স্বয়ং মুজতবা আলীর! এখনো বিদেশ থেকে যেসব ট্যুরিষ্ট বাংলাদেশে আসেন তাদের টু ডু লিষ্টের শুরুর দিকেই থাকে প্যাডেল স্টিমারে চড়া। আমি এখন পর্যন্ত যে কয়জন বিদেশী ট্যুরিষ্টকে সঙ্গ দিয়েছি /রকেটে পেয়েছি তাঁরা সবাই ভ্রমণ শেষে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। BIWTC’র এই সার্ভিস দেশের গর্ব, জাতির গর্ব। আমার মতে বিশ্বের সবচে বড় বদ্বীপ নদীমাতৃক বাংলাদেশকে জানতে, চিনতে, উপলব্ধি করতে নৌ-ভ্রমণের বিকল্প নেই। আপনিই বা বাদ থাকবেন কেন?

সপ্তাহে ৪দিন সন্ধ্যায় বিআইডব্লিওটিসির রকেট সার্ভিসের আওতায় প্যাডেল স্টীমারগুলো ঢাকা ছেড়ে যায় মোড়েলগঞ্জের উদ্দেশ্যে। আর শুধুমাত্র একদিন খুলনা যায় ২৭ ঘন্টা সময় লাগিয়ে।

এই ভ্রমণ করতে আপনার খরচ হতে পারে মানভেদে ৩১০ টাকা থেকে ৫৩০০ টাকা পর্যন্ত। আপনি আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী উপভোগ করে নিতে পারেন এই এন্টিক সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাবার আগেই। নয়তো ভবিষ্যতে আফসোস করতে হবে।

সরকারী এই নৌযানগুলো আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ। প্রাইভেট লঞ্চের যুগে সরকারী কোন প্রচারণা নাই, থাকলে এ সার্ভিস থেকে সরকার বহু অর্থ উপার্জন করতে পারতো। তাই আমাদের সম্পদের প্রচারণা আমাদেরই করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদকে নিজের সম্পদ ভাবার মানসিকতা নিয়ে ভ্রমণে এসব বাহনকে প্রায়োরিটি দিতে হবে। শতবর্ষী হবার কারণে এই নৌযানগুলোর এসি মাঝে মাঝে ঝামেলা করে। এইসব ছোটখাটো সমস্যা মাথায় রেখে ভ্রমণ করবেন। অন্যথায় আধুনিক মধুমতি বা বাঙালি তো আছেই। সেসব নিয়ে আরেকদিন লিখবো

নদী আমাদের দেশের সবচে বড় সম্পদ। তাই নদী সম্পর্কে জানুন, নদীতে ভ্রমণ করুন, ভালোবাসুন নদীকে। নদী দূষণ বন্ধে সোচ্চার হোন। ৭০০ নদী বাঁচলে, বাংলাদেশ বাঁচবে। সরকারী সম্পদ প্যাডেল স্টিমার হোক আমাদের রিভার ট্যুরিজম এর প্রতীক।