বাংলার ইবনে বতুতা উগান্ডায়

বাংলার ইবনে বতুতা উগান্ডায়

উগান্ডা

২০০০ সাল থেকে ১৬ কোটি মানুষের জাতীয় পতাকাকে বহন করে চলছি পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি পৃথিবীর বহু মানুষের কাছে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার কথা! বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের কথা, জীবন ও সংস্কৃতির কথা, সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের কথা। ভ্রমণ করেছি এশিয়া, ওশেনিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ। ১ জুন আমার জীবনের জন্য সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। এদিন আমার শততম দেশ পূর্ণ হয় এবং জাম্বিয়ার জাতীয় দৈনিক পত্রিকা জাম্বিয়া ডেইলি মেইলের বিশেষ ট্যাবলয়েড সানডে মেইলে প্রকাশিত হয় সেই খবর! আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া থেকে শুরু হয়েছিল শততম সফরের যাত্রা! আমি সেই যাত্রায় আফ্রিকার ১২টি দেশ ভ্রমণ করি। সর্বশেষ ভ্রমণ করছি ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, সাউথ আফ্রিকা, লেসোথো, সোয়াজিল্যান্ড ও মোজাম্বিক।

আমার ভ্রমণের সময় অনেক দুর্গম এলাকায় যেতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে বহুবার! আজ পর্যন্ত বেঁচে আছি তা যেন এক আশীর্বাদ। মনে পড়ে অনেক পাহাড়ি অঞ্চলে না খেয়ে থাকার কথা। ক্ষুধার যন্ত্রণায় গাছ থেকে ভেঙে কাঁচা মেজ আর কাঁচা বাদাম খেয়েছি। শুধু তাই নয়, ইথিওপিয়ায় কাঁচা মাংসও খেতে হয়েছে আমাকে! আফ্রিকার এমন কিছু দুর্গম জায়গাতে গিয়েছি, যেখানে কোনো পানি নেই, হাহাকার! নদী শুকিয়ে গেছে, শুকনো নদীর কোনো জায়গা দিয়ে একটু পানি পড়ছে। সেই পানি ছেঁকে ছেঁকে তুলে আনছে মানুষ একটু পানির তৃষ্ণা মেটানোর জন্য! দক্ষিণ ইথিওপিয়ার প্রচণ্ড দাবদাহে ফোস্কা পড়েছিল আমার হাতে। তবে উগান্ডার একটি ভয়ানক ঘটনা বারবার আমার মনে শিহরণ জাগায়।

উগান্ডা

রাতের উগান্ডায় ঘটে যাওয়া আজ এ রাতের বাসে করে তখন উগান্ডার কাম্পালা থেকে রুয়ান্ডা যাচ্ছি। তখন মধ্যরাত। এত বৃষ্টি ছিল যে, বাসের গ্লাস ভেদ করে পানি ভেতরে প্রবেশ করেছে! বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় ড্রাইভার দু-বার কন্ট্রোল হারানোর পর তৃতীয়বার গাড়ি ধাক্কা খেলো গাছের সাথে, গাড়ির সামনের দিকের কিছু অংশ বাঁকা হয়ে গেলেও সব মানুষ অক্ষত ছিল! বুক কেঁপে উঠেছিল কিছুক্ষণের জন্য! সেই মধ্যরাতে আমাদেরকে বৃষ্টির মধ্যে ১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল! প্লাস্টিক মুড়িয়ে বুকের মধ্যে করে ল্যাপটপ আর মোবাইলগুলোকে রক্ষা করেছিলাম উগান্ডার কিছু জংলি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে!

উগান্ডা-রুয়ান্ডার বর্ডারের শেষ রাতটি যেন ছিল যেন আরেক ভয়ঙ্কর অ্যাডভেঞ্চার। বর্ডার এলাকায় পানি উঠেছে, পানি ভরা রাস্তার ওপর মানুষ পার হওয়ার জন্য বড় বড় পাথর ফেলে দিয়েছে। পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় অনুভব করলাম পাথরগুলো পিচ্চিল, তবুও সাবধানী পায়ে হাঁটছি পেছনে ব্যাকপ্যাক নিয়ে। দু-পাশে কি ভয়ানক জঙ্গল, তবু আমি সাহসী পায়ে হাঁটছি! ভয়কে সব ভয়ানক থেকে জয় করতে করতে পথ চলছি!

বহু কথা বহু স্মৃতি! বহু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কথা মনে পড়ে! বন্যপ্রাণীর আক্রমণের শিকার, পাহাড়ি পোকামাকড়ের কামড় খাওয়া, প্রচণ্ড শীতে পাহাড়ি আমেরিকার ইয়েলো স্টোন জঙ্গলে দুটো সুয়েটার দুটো জ্যাকেট পরে ঘুমিয়েছিলাম। কিউবার সিনফুয়েগোস শহরে যাওয়ার সময় গাড়ি নষ্ট হয়ে দুর্গম এলাকায় খাবার না পেয়ে শুধু আখের রস খেয়ে বেঁচেছিলাম!

উগান্ডা

সুন্দর মুহূর্তও!

আফ্রিকা ভ্রমণের সময় কিছু সুন্দর ও মজার মুহূর্তের কথা খুবই মনে পড়ে! আফ্রিকার মধ্যে বতসোয়ানা যেমনি সুন্দর একটি দেশ তেমনি সেখানকার মানুষগুলো। ৩ জুন সন্ধ্যা ৬টায় আমি বতসোযানার কাসানে শহর থেকে বাসে রওনা দিলাম রাজধানী শহর গাবরণে। দু-পাশের চমত্কার ল্যান্ডস্ক্যাপের মধ্যে সুন্দর একটি রাস্তা বেয়ে দ্রুতগতিতে চলছে গ্যাবোরোনমুখি বাসটি। তাত্ক্ষণাত্ টিকেট কাটায় পেছনের সারির দিকে আমার বসার ব্যবস্থা হলো, খুশি মনেই মেনে নিলাম। বাসটিতে ওয়াইফাই থাকায় আমি খুবই খুশি হলাম। সারারাত চলবে গাড়িটি, সকালে আমরা পৌঁছাবো রাজধানী শহরে। বাসটিতে আমি ছিলাম একমাত্র বিদেশি। আমার সিটটি মিললো জানালার পাশে। পাশে বসা ছিল একটি ছেলে। গাড়িটি কিছুদূর যাওয়ার পর ক্ষিদে অনুভব করলাম। শুকনো খাবার আছে কিছু, বের করলাম কিছু ফল আর বিস্কুট। খাবার সময় পাশের ছেলেটির দিকে তাকালাম। পাশে কেউ থাকলে আমি আবার একা খেতে পারি না। তাকে খেতে বললাম, ছেলেটি হাসিমুখে দুটো বিস্কুট আর একটি আপেল নিলো! খেতে খেতে আমরা অনেক গল্প করলাম।

রাত তখন ৮টা, একটু পরেই বাস পৌঁছালো ফ্রাঞ্চিস টাউনে। সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার নেমে আসছিল তখন। বাসটি শহরের একটি পেট্রল পাম্প স্টেশনে থামলো, কন্ডাক্টর সবাইকে বললো ২০ মিনিট যা যা কিনতে চাও কিনে নাও, লম্বা পথে আর নাও থামতে পারে। সবাই নেমে পড়লো, আমিও নেমে দোকানটিতে ঢুকলাম। আরো কিছু শুকনো খাবার কিনলাম। সবাই আবার ঠিক ২০ মিনিট পর সবাই বাসে উঠে বসলো। আমি সবার শেষে উঠলাম, দাঁড়িয়ে ছিলাম কন্ডাক্টরের সাথে শেষে উঠবো বলে। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল! ড্রাইভারকে বলে মোবাইলটি চার্জ দিতে হবে তাই সামনের দিকে ড্রাইভারের পেছনের সিটে কন্ডাক্টরের জায়গায় বসলাম গাড়িতে উঠেই, তাদেরকে বলে মোবাইল চার্জে লাগলাম। পেছনে নিজের সিটে গিয়ে আর বসলাম না। মোবাইল চার্জ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা ভাবলাম। ড্রাইভার, সুপারভাইজার দু-জনই বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞাস করলো, অনেককিছু জানতে চাইলো, আমিও বতসোয়ানার কথা জানতে চাচ্ছিলাম, ততোক্ষণে আমাদের মধ্যে বেশ ভালোভাবে গল্প জমে যায়। এরমধ্যেই বাস কিছুদূর এগিয়ে গেল, প্রায় ১৫ মিনিটের রাস্তা পার হয়ে গেল!

উগান্ডা

হঠাত্ শুনতে পেলাম পেছন থেকে কয়েকজন চিত্কার করছে কার যেন পাশের সিটে একজন মিসিং, কেউ একজন রয়ে গেছে ফ্রান্সিস টাউনের পেট্রল স্টেশনে। ড্রাইভার শুনেই বাস ঘুরিয়ে আবার পেছনের দিকে ছুটলো ফ্রান্সিস টাউনের সেই পেট্রল স্টেশনে! খুবই জোরে চালাচ্ছে। স্টেশনে পৌঁছে কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না! সুপারভাইজার চিত্কার করে বলছে, কই কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না, কেউ তো নেই! তখন পেছন থেকে কেউ বলছে, ওই যে বিদেশি মেয়েটা রয়ে গেছে। এরমধ্যেই আমার পাশের, যারা আমাকে কাছাকাছি সিট থেকে দেখতে পাচ্ছে তারা সবাই হেসে উঠলো! সাথে সাথে সুপারভাইজারও হাসতে হাসতে আমাকে বললো, তোমার পাশের সিটের যাত্রী তোমাকে মিস করছে! সে খুবই উদ্বিগ্ন, ভেবেছে আমরা তোমাকে ফেলে এসেছি। প্লিজ, তুমি একটু দাঁড়িয়ে তাকে তোমার হাতটা উঁচু করে দেখাও। এত বড় বাস, পেছন থেকে সামনের দিকে, সামনের থেকে পেছন দিকে দেখা যায় না! তবুও আমি হাত তুলে হায় বললাম সবাইকে। পুরো বাসের সবাই হৈ হৈ করে চিত্কার করে যেন বাসের ভেতর আমাকে দেখে নিশ্চিত চিন্তামুক্ত হলো। আমি নিজেই হাসলাম, খুব মজা পেলাম। ভাবলাম বতসোয়ানার মানুষগুলো এত ভালো। আমাকে ফ্রান্সিস টাউনে একা ফেলে আসার টেনশনে ওরা চিত্কার করছিল। আবার আমাকে বাসের ভেতর দেখে তারা উচ্ছ্বসিত! একজন বিদেশি আগন্তুক আমি! নিজের সন্তান হারানোর মতোই যেন টেনশন করছিল! ওদের হূদয়ে অচেনা এক আগন্তুকের জন্য এই ভালোবাসা আমি আমার স্মৃতির পাতায় বহন করে চলবো আজীবন!