আজমীর শরীফ ভ্রমণ

আজমীর শরীফ ” এই মুসলিম শরিফ তীর্থ আজমের শহরটি আজকের নয়। পাহাড় বেষ্টিত আনা সাগরের তীরে ৪৮৬ ফুট উচ্চে রমনীয় পরিবেশে সবুজ মরুদ্যানের মত রুপ পেয়েছে শহর। ধর্ম, ইতিহাস আর স্থাপত্য তিনেরই সমন্বয় ঘটেছে এখানে। তেমনই সর্বধর্ম সমন্বয়ে  মিলনক্ষেত্র ও পূণ্যভূমি এই আজমের। আমাদের বাংলাদেশিদের ভারতের ঘুরতে যাওয়ার অন্যতম একটা জায়গা হলো আজমীর শরীফ।

আজমীর শরীফ

আজমীর শরীফ

খাজা মইনুদ্দিন চিশতী হলেন চিশতীয় ধারার ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সুফি সাধক। তিনি ১১৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন ও ১২৩৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি গরিবে নেওয়াজ নামেও পরিচিত। মইনুদ্দিন চিশতীই উপমহাদেশে প্রথম এই ধারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করেন। তিনি ভারতে চিশতী ধারার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ধারা বা সিলসিলা এমনভাবে পরিচিত করেন ;পরবর্তীতে তাঁর অনুসারীরা যেমন, বখতিয়ার কাকী, বাবা ফরিদ, নাজিমদ্দিন আউলিয়াসহ (প্রত্যেকে ক্রমানুযায়ী পূর্ববর্তীজনের শিষ্য) আরো অনেকে ভারতের ইতিহাসে সুফি ধারাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।

প্রারম্ভিক জীবন ও নেপথ্য:

ধারণা করা হয়,খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ৫৩৬ হিজরী/১১৪১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পারস্যের সিসটান রাজ্যের চিশতীতে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি পারস্যে বেড়ে উঠেন। পনেরো বছর বয়সে তার পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে একটি বাতচক্র (উইন্ডমিল) ও একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। কিংবদন্তী অনুসারে, একদিন তিনি তাঁর ফলবাগানে পানি দিচ্ছিলেন তখন তার ফলবাগানে আসেন বিখ্যাত সুফি শেখ ইবরাহিম কুন্দুজী (কুন্দুজী নামটি জন্মস্থান কুন্দুজ থেকে এসেছে)। যুবক মইনুদ্দিন তটস্থ হয়ে যান এবং কুন্দুজীকে কিছু ফল দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এর প্রতিদানস্বরূপ কুন্দুজী মইনুদ্দিনকে এক টুকরা রুটি দেন ও তা খেতে বলেন। এই পর তিনি তার সম্পত্তি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গরীবদের মাঝে বিতরণ করে দেন। এরপর তিনি বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চ শিক্ষার জন্য বুখারার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

সুফি দীক্ষা:

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বোখারা থেকে নিশাপুরে আসেন। সেখানে চিশতীয়া তরীকার অপর প্রসিদ্ধ সুফি সাধক খাজা উসমান হারুনীর নিকট মুরীদ হন/শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার সেবায় ২০ বছর একাগ্রভাবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে উসমান হারুনী তাকে খিলাফত বা সুফি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেন।

আজমীর শরীফ
আজমীর শরীফ

ভ্রমণ:

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তৎকালীন বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত, দার্শনিকসহ অসংখ্য সুফি সাধকের সাথে সাক্ষাত করেন বলে নানা গ্রন্থে তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ইরাকের বাগদাদে আবদুল কাদির জিলানীর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। তাঁর জীবনীতে বর্ণিত আছে যে, এ সময় আব্দুল কাদির জিলানী তাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ইরাকের দায়িত্ব শায়েক শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্থানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো। একই সংবাদ নিজ পীর খাজা ওসমান হারুনীর সাথে মদীনায় অবস্থান ও জিয়ারতকালে নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর পক্ষ থেকে পেয়েছিলেন। তিনি আরব হতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লী হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন।

ধর্ম প্রচার:

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক সুফি ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বীয় পীর উসমান হারুনীর নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তারই মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন।তার বিখ্যাত একটি গ্রন্থ হল “আনিসুল আরওয়াহ”।

খেলাফত প্রদান:

তিনি কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকীকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পন করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।

মৃত্যু:

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব সূর্যোদয়ের সময় ইনতিকাল করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। প্রতিবছর ১লা রজব হতে ৬ রজব পর্যন্ত আজমির শরীফে তার সমাধিস্থলে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে সমবেত হয়।

আজমীর শরীফ
আজমীর শরীফ

যাওয়ার উপায় :

বাংলাদেশ থেকে আজমীরে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে সরাসরি কলকাতাগামী সৌহার্দ্য, শ্যামলী, গ্রীনলাইন, সোহাগের টিকেট সহজেই কিনতে পারবেন। এই পরিবহনগুলো সরাসরি বেনাপোল চলে আসে। এরপর এদেরই লোকেরা ভারতগামী প্রত্যেকযাত্রীর কাছ থেকে পাসপোর্ট জমা নিয়ে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়া শেষ করতে সহযোগিতা করেন। সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করলে আরেকবার কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন শেষে বাস কাউন্টারে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সবমিলিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাস ছাড়তে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। বেনাপোল থেকে ৮৪ কিলোমিটার পথ যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার বেশি লাগে না। তবে এটি নির্ভর করে ওই বাসের চালক ও তার দায়িত্বশীলতার ওপর।

কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সরাসরি আজমীরের ট্রেন পাওয়া যায়। এর মধ্যে অনন্যা এক্সপ্রেস উল্লেখযোগ্য। এই ট্রেনে যেতে সময় লাগবে প্রায় ৩৪ ঘণ্টা। এছাড়াও শিয়ালদহ স্টেশন থেকে আজমীর সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেসে যেতে পারেন। সময় লাগবে ২৭ ঘন্টা ৪০ মিনিট। ভাড়া এসি থ্রী-টায়ার ২৮০০ রুপি। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রাত ১১.০৫ মিনিটে ছেড়ে যায়।। ক্ষেত্রবিশেষে সময় বেশিও লাগতে পারে। ট্রেনটি আজমীরের রেল স্টেশনে নামিয়ে দেওয়ার পর মাজার সড়কে যেতে অটো রিকশায় ৩০ রুপি, রিকশায় ২০ রুপি লাগবে। এছাড়াও জয়পুর থেকে প্রাইভেট গাড়ী ভাড়া করে যেতে পারেন। সময় লাগবে ২ ঘন্টা।

ট্রেনটি আজমীরের রেল স্টেশনে নামিয়ে দেওয়ার পর মাজার সড়কে যেতে অটো রিকশায় ৩০ রুপি, রিকশায় ২০ রুপিতে যাওয়া সম্ভব। মনে রাখবেন, সাথে একজন গাইড নিয়ে নিতে পারলে ভালো হয় l ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশ রাজস্থানের পবিত্র নগরী আজমীরে এসে থাকতে চাইলে মাজার রোড ধরে সোজা সড়ক অথবা এর আশাপাশের সড়কে থাকাটাই ভালো। তাহলে পায়ে হেঁটে সহজেই এখানে পৌছে যাওয়া যায়।

হোটেল:

হোটেলে থাকতে হলে বাংলাদেশিদের কিছুটা সমস্যা পড়তে হতে পারে। কারণ বিদেশি হলেই সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনা মতো একটি অনলাইন ফরম পূরণ করতে হয়। এই পদ্ধতি যদি কোনো হোটেলে না থাকে তাহলে বিদেশিদের এসব হোটেল কর্তৃপক্ষ রাখতে চাইবে না। মাজার রোড থেকে সোজা বের হয়ে একদম শেষ প্রান্তে বাম দিকে কয়েক পা ফেললেই চোখে পড়বে রিগালসহ বহু হোটেল। বাংলাদেশিরা কেউ আজমীরে এলে সাশ্রয়ী ও বেশি দামে দু’ধরনের কক্ষই পাবেন। ১৫০০ রুপি থেকে শুরু করে ৪৫০০ রুপিতে এসি স্যুইট রুমও মিলবে। যোগাযোগের বাহন হিসেবে বাস, অটো রিকশা, ট্যাক্সি ও রিকশা ব্যবহৃত হয়। হাতে যদি সময় থাকে পর্যটন শহরের পাঁচ মিনিটের পথেই পাবেন আনা সাগরের দেখা। তিনদিকে পাহাড় ঘেরা বিশাল এই জলভূমিকে সাগর বলা হলেও আসলে এটি লেক, মাঝে একখণ্ড দ্বীপ রয়েছে। আজমীরে পর্যটকদের বাড়তি আনন্দ ঘোড়ার গাড়ি ও উটের বাহন।