ধুপপানি ঝর্না ভ্রমন

ধুপপানি ঝর্না ভ্রমন সাথে কাপ্তাই লেক, নকাটা ছড়া, মুপ্পোছড়া তো আছেই 😍

ধুপপানি ঝর্ণা বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার একটি ঝর্ণা যা ফারুয়া ইউনিয়নের ওড়াছড়ি নামক স্থানে অবস্থিত। স্থানীয়রা দুপপানি ঝর্না নামেও ডেকে থাকে। স্থানীয় শব্দে ধুপ অর্থ সাদা আর পানি যুক্ত করে এটিকে সাদা পানির ঝর্ণাও বলা হয়।
ঝর্ণাটি লোক চক্ষুর অন্তরালে ছিলো। ২০০০ সালের দিকে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গভীর অরণ্যে দুপপানি ঝর্ণার নিচে ধ্যান শুরু করেন। পরে স্থানীয় লোকজন জেনে ঐ বৌদ্ধ ধ্যান সন্ন্যাসীকে দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় বা উপলক্ষ্যে সেবা করতে গেলে এই ঝরনাটি জন সম্মুখে পরিচিতি লাভ করে। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় ধুপ অর্থ। পানিকে পানিই বলা হয় তঞ্চংগা ভাষায়। ধুপপানি অর্থ সাদা পানির ঝর্ণা।
ঝর্ণার পানি স্বচ্ছ এবং যখন অনেক উচু থেকে তার জল আছড়ে পড়ে তখন তা শুধু সাদাই দেখা যায়। তাই একে ধুপ পানির ঝর্ণা বলা হয়। সমতল থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১৫০। ঝর্ণা থেকে পানি আছড়ে পড়ার শব্দ প্রায় ২ কিলোমিটার দুর থেকে শোনা যায়।

যাওয়ার উপায়ঃ
বৃহস্পতি বার রাত ১০.৩০ এর বাসে উঠে রওনা হয়ে ছিলাম কাপ্তাই এর জন্য । সকাল ৭ টার দিকে বাস আমাদের নামিয়ে দিল কাপ্তাই । কাপ্তাই এসে সকালের নাস্তা খেয়ে নিলাম আমরা। এরপর ট্রলারে উঠেছি। কাপ্তাই লেক এর মধ্যে দিয়ে বিলাইছড়ি আসব। লেকের পানি গুলো কি শান্ত, সুন্দর। ছোট ছোট পাহাড়ের মাঝে লেক। দারুণ লাগছিল। বিলাইছড়ি আসার পথে গাছকাটা চর আর্মি ক্যাম্পে আমাদের থামতে হলো। এখানে আমাদের ট্রলারের নাম্বার, আইডিকার্ড এর কপি নিল এবং ছবি
তুল্লো সবার। এরপর আমাদের নাম লিখে আমাদের বিলাইছড়ি আসার অনুমতি দিল।
শুরু হলো আমাদের মুল জার্নিঃ
কাপ্তাই লেকের মাঝে মাঝে টিলা। টিলার চারপাশে পানি। টিলা গুলোতে মানুষ থাকার ঘর রয়েছে। রয়েছে বর্ডার গার্ড এবং আর্মিদের ক্যাম্প।
বিলাইছড়ি আসতে আমাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টার মত লেগেছে। পুরা পথ ট্রলারে করে এসেছি। আকাশে হালকা মেঘ থাকায় রোদ লাগেনি আমাদের তেমন। ট্রলারের ছাদে বসে চারপাশ দেখতে দেখতে এসেছি।
বিলাইছড়িতে নিরিবিলি নামে একটা বোর্ডিং রয়েছে। এখানে আমরা আমাদের ব্যাগ রেখে জামাকাপড় পরিবর্তন করে ট্র্যাকিং এর জন্য প্রস্তুতি নিলাম। আমরা মম্পছড়া ঝর্ণা দেখতে যাবো। ঝর্ণা দেখতে যেতে হলে প্রায় দুই ঘণ্টার মত ট্র্যাকিং করতে হবে। আর পথে জোঁক ধরতে পারে। জোঁক যেন না ধরে, তাই কেউ কেউ বিশাল মোঝা এবং প্যাড পরে নিল।
ট্রলারে করে আমাদে এক জায়গায় নামিয়ে দিল, যেখান থেকে ট্র্যাকিং শুরু করতে হবে। আমরা ট্র্যাকিং শুরু করলাম। আমরা ছাড়াও আরো কয়েকটা দল দেখলাম। উনারাও মপ্পছড়া ঝর্ণা দেখতে যাবে। অনেক মানুষ হওয়াতে কে কার দলে, তার কোন ঠিক থাকল না। মপ্পছড়া দুই ভাবে যাওয়া যায়। পাহাড়ের নিচ দিয়ে এবং উপর দিয়ে। আমি একটা দলের সাথে উপরের দিকে উঠে গেলাম।
পরে দেখি আমাদের দলের বাকিরা নিচ দিয়ে যাচ্ছে। নিচে আর নামতে ইচ্ছে করে নি। উপর দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তাদের সাথে হাঁটতে লাগলাম। এভাবে পাহাড়ের মাঝে, ঝর্ণার পানি পড়ার পথ ধরে প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটার পর মপ্পছড়া ঝর্ণা দেখতে পেলাম।
যাওয়ার পথ দারুণ ছিল। একটু উচু নিচু। আর বাকি অংশ হচ্ছে ঝর্ণার পানি নামার পথ। ঐ পথ ধরে হাটলেই মপ্পছড়া ঝর্ণা।
ভেবেছি ছোটখাটো একটা ঝর্ণা হবে। কিন্তু গিয়ে দেখি বিশাল একটা ঝর্ণা। আমি অন্য দলের সাথে চলে এসেছি। আমাদের দল এখনো পৌঁছায় নি। তারপর ও ঝর্ণার এখানে অনেক পর্যটক। অনেক মানুষ ঘুরত এসেছে। সবাই ভিজছিল ঝর্ণার পানিতে। ঝর্ণার কাছে গিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। আমিও ঝর্ণার পানিতে ভিজতে গেলাম। পাহাড় বেঁয়ে একটু উপড়ে উঠলাম। যেখানে পানি গুলো সরাসরি পড়ে। এরপর ভিজলাম ইচ্ছে মত।
অনেকক্ষণ ঝর্ণার পানিতে ভেজার পর আমরা ফেরার পথ ধরলাম। বিকেল না হতেই সব কিছু অন্ধকার হয়ে উঠল। একটু একটু বৃষ্টিও পড়া শুরু করল। বৃষ্টি হওয়ার কারণে রাস্তা গুলো অনেক পিচ্ছিল হয়ে উঠল। আমাদের হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। মাঝে মাঝে এমন জায়গা দিয়ে হাঁটতে হয়, যে একটু পিচ্ছিল কেটে পড়লেই অনেক নিচে পড়ে যাবে। বেঁচে থাকার সম্ভবনা থাকবে না।
ঝর্ণা দেখে বিলাইছড়ি ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আমরা ফ্রেস হয়ে খাবার খেয়ে নিলাম। ঐটা না দুপরের খাবার, না রাতের খাবার। এত ভেতর ঘুরতে এসে ভালো খাবার খোঁজা অন্যায়ের মত। আইর মাছ, আলু ভর্তা, ডাল, মুরগি ইত্যাদি আইটেম ছিল। খেতে ভালোই লেগেছে।
সকালে জেগেছি আমরা সাড়ে চারটার দিকে। ৫টার মধ্যে ট্রলার ছেড়ে দিবে। ব্যাকপ্যাক নিয়েই বের হতে হবে। আমরা আর বিলাইছড়ি ফিরব না। তাই সবার ব্যাগ গুছিয়ে নিতে একটু সময় লেগে গেলো। সাড়ে পাঁচটার দিকে আমরা বের হয়েছি ধুপপানি ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
ধুপপানি ঝর্ণা যাওয়ার জন্য প্রথমে আমরা উলুছড়ি পাড়ায় নেমে গেলাম সে হাল্কা কিছু খেয়ে এরপর ট্র্যাকিং শুরু হলো ।
প্রথম কিছুদূর ছিল সমতল। হাঁটতে কষ্ট হয় নি। এরপর শুরু হলো উঁচু নিচু জায়গায় হাঁটা। একবার পাহাড়ের উপড়ে উঠি। আবার পাহাড়ের নিচে নামি। পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে সব কিছু। একটু অসতর্ক হলেই চিৎ হয়ে পড়তে হয়। মানুষ গুলো যেতে যেতে পথ তৈরি হয়ে রয়েছে। ঐ পথ ধরে হাঁটছি আমরা। আমাদের সাথে গাইড ও রয়েছে। প্রথমেই একটা বিশাল উঁচু রাস্তা পাড় হতে হলো। অনেক কষ্টে ঐটা পার হয়ে ভাবলাম এর পর আর একটু হাঁটলেই হয়তো ঝর্ণা দেখতে পাবো। অনেকক্ষণ হাঁটার পর মনে হলো, ঐটা আসলে শুরু ছিল। পুরো ট্রেইলটাই এমন দুর্গম।
বার বার ভাবতে লাগলাম, ঘুরার জন্য কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিন বেস্ট! কোন কষ্ট নেই। নিজেকে এতদিন ট্রাভেলার ভাবতাম। ভাবতাম ট্রেকিং করা কোন ব্যপারই না। ধুপপানি যাওয়ার পথে টের পেলাম কষ্ট কাকে বলে। অনেকেই গিয়েছে, আমরাও পারব এই চিন্তা করে হাঁটতে লাগলাম।
ধুপপানি যাওয়ার ট্রেইল আমার দেখা সবচেয়ে দুর্গম ট্রেইল। প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা ধুপপানি গ্রামে পৌঁছিয়েছি।
ধুপপানি গ্রামটি পাহাড়ের উপরে। আমরা পাহাড়ের আবার নিচে নামতে হবে। ঐ নামার জায়গাটা অনেক খাড়া। আগে যত গুলো পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি, সব গুলো থেকে ভয়ঙ্কর। ঝর্ণা দেখা যাচ্ছিল একটু একটু। এতদূর এসেছি, বাকিটুকুও পারব মনে করে নামা শুরু করলাম। পথ পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে। আমি পা পিছলে পড়ে গেলাম। ব্যথা পাই নি যদিও। আরো সতর্ক ভাবে নামলাম বাকি পথ।
ঝর্ণা দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। কষ্ট সার্থক। ঝর্ণাটি দেখতে অনেকটা গ্যাল্যারির মত। ঝর্ণার পানিতে গিয়ে ভিজলাম।
পরে বিকেলে আমরা আবার উলুছড়ি পাড়ায় ফিরে আসলাম সেখান থেকে আমাদের ট্রলার ছাড়ল বিলাইছড়ি এর জন্য । বিলাইছড়ি এসে আমরা আমাদের ব্যাগ পত্র নিয়ে আবার ট্রলারে উঠে পরলাম । ট্রলারে উঠে আমরা আমাদের রাতের খাবার খেয়ে নিলাম কেননা ধুপপানি থেকে ফিরতে ফিরতে আমাদের লেট হয়েছিল তাই বিলাইছড়ি এসে আমরা সময় পায়নি । আমাদের বাস ছিল রাত ৮ টায় ।
আমাদের এই পুরো ট্রিপে খরচ হয়েছে ৪০০০ সামথিং । আপনারা যদি গ্রুপ করে ঘুরতে যান তাহলে খরচ মোটামুটি ৩৫০০-৪০০০ হাজারের মধ্যেই হয়ে যাবে ।
এইচডি ভিউঃ https://youtu.be/UgYCl2WIz8w
বিঃ দ্রঃ ঘুরতে যেয়ে অপচনশীল কোন কিছু ফেলে আসবেন না, নিজের ময়লা নিজের সাথে ক্যারি করে এনে ডাস্টবিনে ফেলবেন ।