হামহাম অভিযান

হামহাম অভিযানে…

বর্ষার শেষের দিকে হামহাম অভিযানে…
আর দশটা সাধারণ বাঙালি স্বভাব-চরিত্র যেমন, আমার সাথের ট্যুরমেটরা সেরকমই। খাই-দাই, সুযোগ পেলে দুপুরে ভাত-ঘুম দেয়। বন্ধুদের পেলে জাঁকিয়ে আড্ডা বসায়। চায়ের কাপে রাজা-উজির মারে, হুজুগ উঠলে সবার সঙ্গে গলা ফাটায়। আবার হুজুগ চলে গেলে সবার মতোই মিইয়ে পড়ে।



সেরকমই একটা হুজুগ উঠে অনলাইনে, তখন হামহাম অ্যাডভেঞ্চারের কথা উঠলো— সবাই সঙ্গে সঙ্গে নেচে উঠলো। সব বন্ধুদের মোটামুটি হামহাম সম্পর্কে একটা বেসিক আইডিয়া ছিলো আগে থেকেই। হামহাম জলপ্রপাত ছোট-বড় পাহাড়-টিলা, গাছপালা, বাঁশ-বেত এবং লতাগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদে ভরা। পাহাড়ের ওপর দাঁড়ালে ঘন সবুজের ওপাশেই দেখা যায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা। সেখান থেকে প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ৩০ সেপ্টেম্বর ভোর ৫.৩০ ঘুম ঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে উঠে ট্রেন ধরার তাগিদে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সাথে ছিলো ৮জনের মতো ট্যুরমেট সিলেট থেকে। সকাল ৬.১৫ কালনী এক্সপ্রেসে করে রওনা দিলাম শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আগে থেকে প্ল্যান ঠিক করে রাখায় ঢাকা ও বি বাড়ীয়ার থেকে আরো ১০জন জয়েন করবে শ্রীমঙ্গলে। তারাও আমাদের মতো ট্রেনে করে আসবে তবে সেটা পারাবত এক্সপ্রেসে। সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন সকাল ৮.৪০ শ্রীমঙ্গল পৌঁছে যায়। পৌঁছেই ৫মিনিট হাঁটা দূরত্বে পানসী রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভরপেট উদরপূর্তি সেরে নেয়। বাকিদের আসার অপেক্ষায় তখন। বাকিদের ট্রেন এসে পৌঁছালো সকাল ১০.৫০। শ্রীমঙ্গল থেকে ১জন বড় ভাই; জয়েন করলো। ব্যাস হয়ে গেলাম মোট ১৯জনের টিম। দুইটা জীপ গাড়ী রিজার্ভ করে (আসা-যাওয়া) বের হয়ে পরি হামহাম অভিযানে। জীপ গাড়ী মূলত আপনাদের কলাবনবস্তীতে বা কলাবন পাড়াতে নামিয়ে দিবে। যে কোন গাড়ী ভানুগাছ হয়েই কলাবনপাড়া যায়। কলাবন পাড়াতে নেমে সেখান থেকে মূলত ট্রেকিং শুরু। আগেই বলে রাখা ভালো, হামহামে আমি এর আগে আরো ৪বার গিয়েছি। শুধুমাত্র পরিচিত বন্ধু ও কাছের মানুষদের মন রাখতে আবারো ওদের সঙ্গী হলাম। কলাবন পাড়াতে নামলেই ছোট ছোট বাচ্চারা আপনাদের ঘীরে ধরবে ওদের থেকে ট্রেকিং বাঁশের লাঠি নেবার জন্য। জনপ্রতি ৫টাকা দিয়ে লাঠি কিনে ব্যাস এবার হাঁটা শুরু করুন। কারণ এটাই আপনার৷ পাহাড়ে উঠার একমাত্র অবলম্বন। যাবার পথে একটা লোকাল দোকান থেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে যাবেন। ভাত, চা পাতার ভর্তা, আলুভর্তা, ডিম, মাংস অর্ডার করে যেতে পারবেন এখানে। কারণ ফিরার পথে নিজেকে ক্ষুধার্ত বাঘ মনে হবে। আগে থেকে অর্ডার না দিলে ফিরে এসে কিছুই পাবেন না খাবারের জন্য প্যাকেজ প্রাইজ ১০০-১৫০ মধ্যে সীমাবদ্ধ৷
সহজে যেভাবে যেতে পারেনঃ সবচেয়ে ভালো হয় ঢাকা থেকে সকাল ৬.২০ পারাবত এক্সপ্রেসে করে ভানুগাছ স্টেশনে নামবেন। সকাল ১১টায় আপনি ভানুগাছ স্টেশনে পৌঁছাবেন। সেখান থেকে দেরী না করে ৫জনের জন্য একটা সিএনজি আসা যাওয়া রিজার্ভ করে চলে যাবেন কলাবনপাড়া। ভাড়া পরবে ৮০০-১০০০টাকা মধ্যে। আসার সময় বলবেন শ্রীমঙ্গল নামিয়ে দিতে। যানবাহন থেকে নামার পর পুরোটাই হাঁটতে হবে টিলাবেষ্টিত বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। স্বাভাবিক গতিতে হাঁটলে হামহাম পৌঁছাতে সময় লাগবে আড়াই ঘন্টা। হাঁটা জানা থাকলে ১.৩০ মিনিটে পৌঁছে যাবেন।



প্রথমেই বলেছি আমাদের জলপ্রপাত দেখতে যাওয়ার দিনটি বর্ষা মৌসুমের শেষের দিকে হওয়ায় ভোর থেকে বৃষ্টি শুরু হয় এবং প্রায় সারাদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছিল। আমরা বনের ভেতর প্রবেশ করার আধা ঘণ্টা পরই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয় এবং ১ ঘণ্টার মতো সমানতালে বৃষ্টি হয়। ফলে পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ পিচ্ছিল হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে জোঁকের উপদ্রব বেড়ে যায়। আমাদের টিমের সাত সদস্যকে কয়েকবার জোঁকে ধরেছিল, যা ছিল কিছুটা আতঙ্কের এবং পথ পিচ্ছিল হওয়ায় হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে গিয়েছিল। অবশ্যই সাথে করে টি-শার্ট এবং ট্রাউজার কিংবা থ্রি-কোয়ার্টার আর বার্মিজ স্যান্ডেল বা জুতা পরে যাবেন। আপনাকে অবশ্যই কিছু খাবার ও পানি সঙ্গে নিতে হবে। সেটা যদি হয় শক্তিবর্ধক ও দানাদার জাতীয়, তাহলে ভালো। যেমন খেজুর, কলা, আপেল। সঙ্গে গ্লুকোজ কিংবা স্যালাইন। এ ছাড়া কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধপত্র। হামহামে যাবার জন্য সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো মানসিক ইচ্ছা ও শক্তি থাকতে হবে। কারণ আপনাকে যাওয়া-আসা মিলে ৪ ঘণ্টা হাঁটতে হবে। সর্বসাকূল্যে ছোট-বড় ১১টি পাহাড় অতিক্রম করতে হবে। সর্বশেষ পাহাড়টিতে যাওয়ার পরে আপনাকে আনুমানিক ১২০০-১৩০০ ফুট নিচের দিকে নামতে হবে যাতে কোনো স্বাভাবিক সিঁড়ি নেই, যা সম্পূর্ণ খাড়া এবং আঁকাবাঁকা পথ। যদি কেউ অসাবধানবশত হোঁচট খায় বা পড়ে যায় তাহলে ঘটে যেতে পারে বড় রকমের দুর্ঘটনা। সুতরাং পাহাড়ে ওঠানামার সময় অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে।
**ঘুরি মাতৃভূমি, পরিষ্কার রাখি জল, স্থল, পাহাড়, বন্দর, সমুদ্র সৈকত। নিজের দেশকেও পরিষ্কার রাখা দেশপ্রেমের পরিচয়**