ব্যাকপ্যাকিং টু সাউথ আমেরিকাঃ বলিভিয়া পর্ব ২

সালার দে ইউনি (World Largest Salt Flat)

লবন সাম্রাজ্যে একদিন

লা পায শহরে প্রায় পাঁচদিন কাটানোর পর এইবার ঠিক করলাম ইউনি তে যাবো সালার দে ইউনি দেখতে। লবনের রাজ্য পরিদর্শন, ওয়ার্ল্ড লারজেস্ট সল্ট ফ্লাট। যার ম্যাজিকাল ছবি দেখে আমি এক ভেতো বাঙালি এতদুর চলে আসছি। আগের পর্বে যে সেরগিওর কথা বলেছিলাম তার সাথে প্রতিদিনই দেখা হয় বিকেলে নাইলে সন্ধ্যার পর। আলাপ সালাপ হয় আর একসাথে এক কাপ কোকা চা খাই। ও লকি হোস্টেলের সাথে রিলেটেড কিছু করে, হয়তো ব্যাবসা নাইলে পার্ট টাইম চাকরি। আমি ডিটেইলস জিজ্ঞাস করিনাই। মানুষের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে আমার আগ্রহ খুবই কম। সেরগিওর সাথে দেখা হওয়া মাত্র দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমোন আছি। মাথা ব্যাথার কি খবর আর বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী ইয়াতিরিদের খোজ খবর দেয়। কোন ইয়াতিরি কার কি সমস্যার সমাধান করসে এসব। সেরগিও খুব অবসেসড উইচ ডাক্তারদের ব্যাপারে। তার খুব ইচ্ছা আমার একটা যাদুটোনা টাইপ চিকিৎসা করাবে যাতে করে আমার সারাজীবন আর মাথা ব্যাথা করবেনা আর সেই সাথে আমার স্টোমাক খুব স্ট্রং হবে, পাথর খেলেও হজম করে ফেলতে পারবো। তার পরিচিত ইয়াতিরি বলসে আমার লাংস আর স্টোমাকের উপর খারাপ আত্তা ভর করসে, কঠিন ট্রিট্মেন্ট লাগবে, কমসে কম দুই দিনের সেশন। আমি সেরগিও কে বলি আমার দেশেও অনেক ইয়াতিরি আছে, সর্ব রোগের চিকিৎসক, যাদু টোনা, বান মারা সহ অনেক জটিল ও গোপন রোগের চিকিৎসা করে আমার দেশের ইয়াতিরি রা, সো আমরাও কোনো অংশে কম না হে হে। কিন্তু তার কেনো জানি আমার কথা বিশ্বাস হয়না। একটা কনফিউজড দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে বলে দেখো ইনকা ইয়াতিরি হচ্ছে বেস্ট, ইউ আর লুজিং ইউর চান্স মাই ফ্রেন্ড।

সেইদিন ডেথ রোড থেকে ফিরে হোস্টেলের সামনের রাস্তায় আবার সেরগিওর সাথে আলাপ। বললাম তারে যে আমি ইউনি যাবো। তার থেকে কিছু বুদ্ধি নিলাম। কারন ইউনি যাওয়ার অনেকগুলা উপায় আছে। আর সবচে কমন উপায় হলো বাস এ যাওয়া। কিন্তু বিভিন্ন ব্লগ পড়ে একটু ঝামেলা মনে হইসে আমার। ফেলো ট্রাভেলারদের থেকে কিছু ডিটেইলস জিজ্ঞাস করিনাই কারন ওরাও আমার মতোই, তেমন কিছু ডিটেইলস জানেনা, একমাত্র বন্ধু গুগল এর উপর ভরসা করে আর বিভিন্ন ব্লগ পড়ে চলে আসছে। সো লোকাল মানুষজনের ইনফরমেশন যাচাই করে নিবো। এরমদ্ধে জানলাম ইউনি এর উচ্চতা আরো বেশি। সমুদ্রপ্রিষ্ঠ হতে ১৩০০০ ফুট উপরে। তাই আমি খুব সতর্ক এই যাত্রায়, নতুন কোনো বিপদে পড়তে চাইনা। । যাইহোক সেরগিওর সাথে আলাপ করে বুঝলাম মাক্সিমাম মানুষ বাসে যায়। ৭৫০ কিলোমিটার রাস্তা, সময় লাগে ১০-১২ ঘন্টা। বাস আছে আবার দুই রকম। একটার নাম কমা সার্ভিস আরেকটার নাম সেমি কমা সার্ভিস। কমা বাস মানে পুরা স্লিপিং বেড, আমাদের দেশে এরকম কয়েকটা বাস চালু হইসে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার যায়। লোকজন দুস্টামি করে নাম দিসে হানিমুন বাস। আর সেমি কমা মানে হইলো সিট হালকা বেন্ড করা যাবে কিন্তু কমা বাসের মতো না। মুল সমস্যা হলো মাঝে মাঝেই পাহাড়ের পাথর ধসের জন্য রুট ক্যান্সেল হয় আর বলিভিয়ান ড্রাইভার রা খুব রাফ ড্রাইভ করে আর সন্ধার পর থেকে মোটামুটি এলকোহলের উপর থাকে। বাসের টিকিট পাওয়া যায় সেই ট্যুরের দোকানগুলায়। সেইখানেও অনেক দামাদামি চলে।তবে মোটামুটি ১৫০ বলিভিয়ানো পড়ে যাওয়ার পথের ভাড়া। আশার পথে আবার ভাড়া কিছু কম নেয়। ১০০-১২০ বলিভিয়ানোর মতো। যার থেকে যা নিয়ে পারে। (১ বলিভিয়ানো= ১৩ টাকা)

আবার ট্রেনেও যাওয়া যায়। তবে সেইটা আরো লম্বা জার্নি। সেই ডিটেইলসে গেলাম না। আর আছে ফ্লাইট সার্ভিস। এল আল্টো এয়ারপোর্ট থেকে ইউনি এয়ারপোর্ট। আমাজোনাস, বোআ ডেইলি তিনটা রিটার্ন ফ্লাইট। অনলাইনে এডভান্স টিকিট করলে ২২০-২৩০ ডলারের মতো লাগে কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, এডভান্স টিকিট না করে ট্র্যাভেল এজেন্ট অফিসে করলে অন দ্যা স্পট অনেক কম দামে পাওয়া যায়। ১৫০-১৮০ ডলারের কাছাকাছি। বহু চিন্তা ভাবনা করে আমি ফ্লাইট টিকেট করলাম। কোনো রকম ঝুকি নিতে চাইনা এই হাই অল্টিচ্যুড দেশে।
সকালের ফার্স্ট ফ্লাইটে চলে গেলাম ইউনি। সময় লাগসে মাত্র ৫০ মিনিট। ইউনি এয়ারপোর্টে নেমে আমিতো অবাক। ধুধু মাঠের মাঝখানে বিমান নামতেসে একটার পর একটা। খুব ছোট একটা টার্মিনাল বিল্ডিং, দেখে মনে হলো আমাদের সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট থেকেও ছোটো। সেই এয়ারপোর্টের এক নিয়ম হলো আপনাকে এয়ারপোর্ট চার্জ আলাদা পে করতে হবে। এইটা বিমান ভাড়ার সাথে যুক্ত না। অবশ্য খুব একটা বেশি না সেই চার্জ। ফ্লাইট থেকে নেমে এয়ারপোর্টের সামনে টাক্সি নিয়ে আমি চলে গেলাম সোজা ইউনি শহরের ভিতরে। ভাড়া লাগসে ১০ বলিভিয়ানো।

শহরে গিয়ে আমার প্রথম কাজ হলো সালার দে ইউনির ট্যুর বুক করা। অনেক অনেক কোম্পানি ট্যুর অফার করতেসে, এক দিনের ট্যুর, দুই দিনের ট্যুর। সেইখানেও বিরাট দামাদামি। পুরা কাচাবাজার স্টাইল। যাইহোক অনেক দামাদামি করে আমি ১০০ বলিভিয়ানো দিয়ে একটা কোম্পানিতে ১ দিনের ট্যুর বুক করসি যদিও ওদের ওয়েবসাইট প্রাইস প্রায় ২০০-২৫০ বলিভিয়ানো। ট্যুর ইনক্লুডস লাঞ্চ।.৬ জনের গ্রূপ। একটা ফোর হুইলারে করে নিয়ে যাবে ট্রেইন সিমেট্রি, ইনকা হুয়াসি আইল্যান্ড, সালার দে ইউনি আর সন্ধ্যায় আমাকে নামায় দিবে এয়ারপোর্ট। আমি রাতের ফ্লাইটে চলে যাবো লা পায। আমার আবার একটা কন্ডিশন ছিলো যে আমাদের গাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকতে হবে। কারন হিসেবে বললাম আমার সিকনেসের কথা। ওরাও কোনো রকম আপত্তি ছাড়াই মেনে নিলো। গাড়িতে নেওয়ার জন্য দিলো ছোটো অক্সিজেনের সিলিন্ডার। আমার ব্রিদিং প্রব্লেম হলেই গাড়িতেই বসে বসে অক্সিজেন নিয়ে নিবো। এইবার একটু নিশ্চিত হলাম।
প্রচুর পানি খাচ্ছি যাতে ডিহাইড্রেটেড না হই আর অপেক্ষা করছি আমার ফোর হুইলারের জন্য। এরমদ্ধে ট্যুর কোম্পানির এক লোক এসে খুব রিকুয়েস্ট করসে যাতে আমি আমার গ্রুপের অন্য কাউরে আমার ট্যুরের প্রাইস না বলি। ওদের আসলে কোনো প্রাইস স্ট্যান্ডার্ড নাই, যার থেকে যা নিয়ে পারে। ওরে নিশ্চিত করলাম আর বললাম যদি রাস্তায় অক্সিজেন বোতল থেকে অক্সিজেন না পাই তাহলে আমি মাইক নিয়া সবাইকে আমার প্রাইস বলে দিবো। সে মাইকের বেপারটা কি বুঝসে কে জানে আমাকে বলল গুড অক্সিজেন নো প্রব্লেম। আমি এর মদ্ধে একটু টেস্ট করে দেখসি, অক্সিজেন ভালোই বের হয়।

কিছুক্ষন অপেক্ষার দেখলাম একটা লাল রঙের টয়োটা ল্যান্ডক্রূজার হাজির ট্যুর অফিসের সামনে। অফিস থেকে কিছু সাপ্লাই উঠালো আমাদের লাঞ্চের জন্য। এই গাড়িতে আমরা ছয় জন যাবো। দেখতে দেখতে এই গাড়ির বাকি পাঁচজন ট্যুরিস্ট ও হাজির। আসলে তারা সবাই আশেপাশেই ছিলো, খেয়াল করিনাই। অবশ্য খেয়াল করার সময় নাই আমার, আমি আছি আমার পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে। যাইহোক আমাদের এই গাড়ি যিনি চালাবেন তিনিই আমাদের গাইড। নাম কার্লোস। ভালই আলাপি মানুষ মনে হলো প্রথমে দেখেই। একে একে বাকি পাচজন ট্যুরিস্টের সাথে পরিচিত হলাম। একজন হলো আমেরিকান, ৫৮ বছর বয়স্ক টেকো মাথা, নাম কেডম্যান। খুব মজার ক্যারেক্টার। পরে তার কাহিনি বলবো। আছে দুই কানাডিয়ান বোন। ভলান্টিয়ার হিসেবে আসছে ছয় মাসের জন্য, পাশের সিটি পটোসি তে একটা এতিমদের স্কুলে পড়ায়। সোজা বাংলায় বলিভিয়ান এতিমখানার অবৈতনিক শিক্ষিকা। আর আছে একটা কাপল। ফ্রেঞ্চ ছেলে আর জার্মান মেয়ে। এই বছরের কোনো একসময় তাদের দেখা হইসিলো এন্টার্কটিকায়। প্রথম দেখায় প্রেমে পরসে আর এখন প্রেম উদযাপন করার জন্য আসছে সালার দে ইউনিতে। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগসে অবশ্য।

সবার সাথে সবার পরিচিতি পর্বের পর কার্লোস গাড়ি স্টার্ট দিলো। প্রথমে আমাদেরকে নিয়ে গেলো ট্রেইন সিমেট্রিতে, ইউনি শহরের খুব কাছে। এইটা একটা ট্রেইনের কবরস্থান। অনেকগুলা পুরানো ট্রেইন আর ধংস হয়ে যাওয়া রেললাইন যেন কালের সাক্ষী হয়ে দড়িয়ে আছে। উনিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশরা এই রেল লাইন শুরু করে এই অঞ্চলের খনিজ সম্পদ পরিবহনের জন্য। এই অঞ্চলে আছে বেশ কিছু রুপার পাহাড়। তাছাড়া অন্যান্য খনিজতো আছেই। পরে লোকাল আদিবাসী লোকজন নিজেদের ভালো বুঝতে পেরে ব্রিটিশদের রেল পরিবহন সিস্টেমে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করে। এর মধ্যে খনি গুলাও বন্ধ হয়ে যায় আস্তে আস্তে। খুব বেশিদিন ব্রিটিশরা এইখানে কারবার চালাতে পারেনাই। তারা চলে যাওয়ার সময় লোকোমোটিভগুলা যেমন অবস্থায় ছিলো ঠিক তেমন অবস্থায় রেখে চলে যায় আর আইখান থেকে জন্ম নেয় ট্রেইন সিমেট্রি। জংধরা এই ট্রেন গুলার ছাদে ট্যুরিস্টরা উঠে ছবি-টবি তুলে।
এই পর্যায়ে আমাদের গাইড কার্লোস একটা ব্রিফিং দিলো আর বলে দিলো এখন আমরা সালার এর দিকে যাত্রা শুরু করবো। এরমাঝে আমাদেরকে একটা চেকপয়েন্টে থামতে হবে। সেখানে হয়তো আমাদের আইডি কার্ড চেক করতে পারে সারকারি লোকজন।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক গাড়ি চালানোর পর আমরা সালার দে ইউনির এন্ট্রেন্স পয়েন্টে পৌছাই। সালারে পৌঁছানোর পর আমার অনুভূতি আর এই ম্যাজিকাল লবন সমুদ্র দেখতে কেমন আমি এইখানে লিখে বুঝাতে পারবোনা। সংক্ষেপে একটাই কথা বলতে পারি, আমি এই বিশাল লবন প্রান্তরে এসে চারপাশের অদ্ভুত ল্যান্ডস্কেপিং আর এর বিশালতা দেখে বাক্রুদ্ধ। দিগন্ত বিস্তৃত সাদা লবনের মাঠ। এই লবনের সমুদ্রে হয় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত। এই বিশাল সাদা সাম্রাজ্যের মাঝখান দিয়ে কার্লোস গাড়ি চালাচ্ছিলো তখন আমি ভাবতেসিলাম কই নিয়ে যাচ্ছে, চারদিকে একইরকম, পুরা মরুভুমির মতো। দিকভ্রান্ত মরুচারি মনে হচ্ছিলো নিজেদেরকে। কার্লোস কে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম আমরা আসলে কই যাচ্ছি, রুট ভাল চিনে কিনা কার্লোস। হো হো করে হেসে উঠলো সে। পাশের ডিস্ট্রিক্ট পটোসি’র আদি বাসিন্দা কার্লোস, এই সব এলাকা তার হাতের তালুর মতো চিনে, অনেক দুরের আবছা দেখে যায় এমন কয়েকটা পাহাড় লক্ষ করে তার গাড়ি চলতেসে। আমি অবশ্য অনেকদুরে সাদা লবন সমুদ্র ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনা। সালার স্রিষ্ঠি হওয়ার জিওলজিকাল ইতিহাস অনেকগুলা প্রিহিস্টরিক লেকের রুপান্তরের সাথে রিলেটেড। প্রাগৈতিহাসিক ভুমিকম্প আর আগ্নেওগিরির অগ্নুৎপাতের ফলে আন্দেস পরবতমালা তৈরি হওয়ার সময় এই অঞ্চল একটা হাই প্লেটূ বা সহজ বাংলায় হাই ল্যান্ড হিসেবে অবিরভূত হয়। এই হাই প্লেটু তে লবন পানির লেক, মিঠা পানির লেক ছিলো। আনুমানিক ৪০ হাজার বছর আগে এই সালার ছিলো মিনচিন নামের এক বিশাল প্রাগৈতিহাসিক লেকের অংশ পরে সেই লেক মিনচিন ট্রান্সফরম হয়ে আরো কয়েকটা লেক হয় আর কিছু অংশ হাজার বছরের সূর্যের আলোয় শুকিয়ে লবন জমা হয়ে সৃষ্টি হয় সালার দে ইউনি।

আইমারাদের মিথ অনুযায়ী অবশ্য অন্য কাহিনি। এক ত্রিভুজ প্রেমের গল্প আছে সালার দে উয়ুনির সৃষ্টির কারন হিসেবে। এই সালার এর পাশে ঘিরে আছে কুসিনা, কুস্কু আর তুনুপা নামের পাহাড়। আইমারা রা বিশ্বাস করে একসময় এই পাহাড়গুলো বিশাল আকারের মানুষ ছিলো। একসময় তুনুপা আর কুস্কু বিয়ে করে কিন্তু পরে কুস্কু তার বউ তুনুপার সাথে বিট্রে করে কুসিনার প্রেমে পড়ে তুনুপাকে ছেড়ে চলে যায়। আর তখন তুনুপা তার ছোটো বাচ্চাকে ব্রেস্টফিডিং করার সময় কান্না শুরু করে। তুনুপার চোখের পানি বুকের দুধের সাথে মিশে তৈরি হয় এক বিশাল লবনাক্ত সাদা পানির লেক, হাজার হাজার বছর ধরে যার পানি শুকিয়ে হয়েছে লবন সমুদ্র সালার দে ইউনি। প্রায় ১১০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সালার দে ইউনির লবনের তলদেশে আছে অনেক মুল্যবান খনিজ পদার্থ। ধারনা করা হয় সারা পৃথিবীর ৪৫% লিথিয়াম মজুদ আছে এই সালার দে ইউনিতে।

কার্লোসের ব্রিফিঙের পর আমরা টিমের সবাই আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। সহযাত্রীরা আমার আরাম আয়েসের খোজ খবর নিচ্ছে, কোনো সিকনেস ফিল করছি কিনা এসব। আমার অবশ্য সিকনেস ফিল হচ্ছেনা। অক্সিজেনের বোতল টা সিটের পিছনে রেখে দিলাম। এযাত্রা কোনো সমস্যা হবেনা আশা করি। আমাদের এরপরের গন্তব্য সালার দে ইউনির মাঝে সল্ট হোটেল। আগেই কার্লোস ঘোষণা দিলো সল্ট হোটেলে গিয়ে আমরা আমাদের লাঞ্চ সেরে নিবো। সালার দে ইউনিতে যখন ট্যুরিস্ট আসা শুরু হলো তখন এই লবন প্রান্তরে হোটেল বানানো শুরু করলো কিছু মানুষ। ট্রেডিশনাল কন্সট্রাকশন মেটেরিয়ালের পরিবর্তে তারা লবনের ব্লক বেবহার করে এই হোটেল গুলা বানালো নব্বই সালের শুরুর দিকে। কিন্তু পরে যখন বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা নিয়ে ঝামেলা শুরু হলো এবং আশেপাশে পলিউশন শুরু হলো তখন দুইহাজার সালের শুরুর দিকে এই হোটেল্গুলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই খানে সেই স্থাপনাগুলা রয়ে গেছে। হোটেলের দেয়াল থেকে শুরু করে চেয়ার টেবিল আলমিরা সবই বানানো হইসে লবনের ব্লক দিয়ে। এখন পর্যটকরা সেই লবনের টেবিল চেয়ারে বসে খাওয়া দাওয়া করে। দুপুর বেলা সল্ট হোটেলে পৌঁছে আমরাও লবনের টেবিল চেয়ারে খেতে বসলাম। খাওয়া হিসেবে আসলো লামার মাংসের স্টেক সাথে বিভিন্ন রকম চিজ আর সালাদ আর খাবার শেষে লোকাল ফ্রূটস। লামার মাংস সেইরকম শক্ত। এর মধ্যে কোক খেতে গিয়ে আমি আবার আমার প্লেটের লামা স্টেকের উপর পুরা এক গ্লাস কোক ঢেলে দিয়েছি। যদিও অসাবধানতা বশত কাজটা করসি কিন্তু দেখলাম রেজাল্ট খুব একটা খারাপ না। শুকনা লামা স্টেকের উপর ঠান্ডা কোক পড়ে মাংস একটু নরম করসে। আমি সেই কোকে ভিজানো লামার মাংস ছুরি দিয়ে কেটে খাচ্ছি আর আমার সহযাত্রীরা তাকাই তাকাই দেখলো খালি। টেকো আমেরিকান ক্যাডম্যান জিজ্ঞাস করলো বিষয়টা কি, কোক দিয়ে স্টেক কেনো খাচ্ছি। তাকে বললাম এইটা ইম্প্রোভাইজড মেনু কোকোলামা, কোক দিয়েই খেতে হয়। তাকে আরো বললাম পৃথিবীতে তিনটা লামা আছে, বলিভিয়ান লামা, দালাইলামা আর কোকোলামা। সে বেশ কনফিউসড এখন। খেতে খেতে হটাৎ বলতে শুরু করলো তার বউএর কথা। খুব নাকি মিস করতেসে কারন বউ থাকলে এই শক্ত লামার মাংস তাকে চাবাইতে হতোনা। আমি খালি বললাম পতিভক্ত আমেরিকান বউ তোমার। সাথে সাথে দুকান বিস্ত্রিত এক হাসি দিয়ে বললো তার বউ আমেরিকান না, খাটি কলম্বিয়ান। সে খুব অল্প বয়স্কা এক কলম্বিয়ান তরুণী বিয়ে করে তাকে আমেরিকা নিয়ে আসছে বছর তিনেক আগে আর সেই কলম্বিয়ান নাকি তার খুব টেক কেয়ার করে, পারলে তার জন্য জীবন দিয়ে দেয়। এই বলে কলম্বিয়ানদের খুব সুনাম শুরু করলো। সেই কমপ্লিমেন্টগুলি এইখানে প্রকাশযোগ্য না। যাইহোক সবার খানাপিনা শেষ হলে কার্লোস এসে ঘোষণা দিলো আমরা এখন সালারের মাঝখানে কোন এক জায়গায় যাবো ছবি তোলার জন্য। ইন্সটাগ্রাম আর ট্র্যাভেল ব্লগ সাইটে যেসব ফানি পিকচার আমরা দেখি সেইগুলি তুলবো এখন। চলার পথে এক জায়গায় থেমে ফটোগ্রাফিটা সেরে নিলাম। সবাই মিলে বেশ কিছু ফানি গ্রূপ ছবি তুললাম।

এবার আমাদের যাত্রা ইনকাহুয়াসি আইল্যান্ড। এইটা কে ফিশ আইল্যান্ড ও বলে। সালার এর মাঝখানে এই আইল্যান্ড দূর থেকে দেখতে অনেকটা মাছের মতো। পুরা আইল্যান্ড জুড়ে আছে বিশালাকার হাজার বছরের পুরান অনেকগুলা ক্যাকটাস। এত বড় ক্যাকটাস থাকতে পারে পৃথিবীতে আমার ধারনায় ছিলোনা। আর আছে কোরালের মতো দেখতে বিভিন্ন স্ট্রাকচার। কোরাল্গুলা দেখতে অনেকটা আমাদের সেইন্টমারটিনের কোরালের মতোই। পরে কার্লোসের ব্রিফিং শুনে বুঝলাম এইটা আসলে একটা বিরাট আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ছিলো। ৪০০০০ বছর আগে লেক মিনচিন স্রিস্টির সময় পুরাটা লেকের পানিতে ডুবে যায়। এই ছিলো ইতিহাস।

ইনকাহুয়াসি আইল্যান্ড ঘুরে ফিরে দেখতে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা সময় লেগে যায়। এইবার ইউনি শহরে ফেরার পালা। এখনো আড়াই তিন ঘন্টার যাত্রা। ফেরার পথে সালারের মাঝখানে কোথাও আমরা সূর্যাস্ত দেখলাম। সাদা লবন সমুদ্রের মাঝে সূর্যাস্ত। দেখতে কেমন লাগছিলো আমি লিখে বুঝাতে পারবোনা। আমি পুরা ট্যুরটায় চারদিকে দেখতে এত ব্যাস্ত ছিলাম আর এতো অবাক হচ্ছিলাম ম্যাজিকাল ল্যান্ডস্কেপ দেখে যে খুব বেশি ছবি তুলতেও ভুলে গেছি যদিও ইচ্ছা ছিলো হাজারখানেক ছবি তুলে আনবো সালার দে ইউনির।
পথে যেতে যেতে কার্লোসের সাথে অনেক কিছু নিয়ে আলাপ হলো। খুব শান্ত নিস্তরঙ্গ, উচ্চাশা বিহিন লেইডব্যাক জীবন তাদের। যেখানে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব নিয়ে কেউ বিচলিত হয়না। আর সেইটাই বোধহয় শান্তির প্রথম পাঠ।

যাত্রা শেষ হলো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমি নেমে গেলাম ইউনি এয়ারপোর্টে। ফ্লাইট ধরতে হবে লা পাযের উদ্দেশে। ঠিকঠাক মতো ফ্লাইট ধরে লা পায গিয়ে ঠিক করলাম আমি এত হাই অল্টিচ্যুডে আর থাকবোনা। নিচু অল্টিচ্যুডের কোনো শহরে চলে যাবো। যে ভাবা সেই কাজ, চলে গেলাম আরেক শহর সান্তা ক্রূজ দে লা সিয়েরা। তারপর সেখান থেকে আবার চলে গেলাম মেক্সিকোর ইউকাটান প্রভিন্সে মায়া সভ্যতা দেখার জন্য। ইতিহাসে তাদের সম্পর্কে একটা কথা খুব বলা হয় ‘ the Mayans disappeared’
একটা পুরা সিভিলাইজেশন কেনো রাতারাতি হাওয়া হয়ে গেলো তা ছিলো এক বিরাট বিস্ময়। সেই গল্প আরেকদিন।

হ্যাপি ট্রাভেলিং

লিখেছেন: আব্দুল্লাহ আল মামুন