প্যাডেল ষ্টিমারে ২১ ঘন্টা

শনিবার, ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা ৬.১৫। দাঁড়িয়ে আছি সদর ঘাটের লালকুঠির ঘাটে। । ঘাটে যাত্রিদের অপেক্ষায় প্রায় শতবর্ষী কমলা রঙের একটি নৌযান । নৌযানটির ছবি তোলায় ব্যস্ত ১০ থেকে ১৫ জন বিদেশী পর্যটক। এটিতে উঠার জন্য নেই কোন ভীড়, নেই কোন হাকডাক। বলছি ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল ষ্টিমারের কথা। আজ আমরা যাচ্ছি প্যাডেল ষ্টিমারে ২১ ঘন্টার রাজকীয় ভ্রমণে গন্তব্য, ঢাকা থেকে মোরলগঞ্জ (বাঘেরহাট), পাড়ি দেব ৭-৮ টি জেলা, ১০ টি ঘাট, প্রায় ১৫ টি নদী। নদীর নামগুলোও কেমন যেন অদ্ভুত সুন্দর-বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা,মেঘনা, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, বিষখালী , গাবখান , সন্ধ্যা, কালিগঙ্গা, কচা, বলেশ্বর , পানগুছি। শতবর্ষী প্যাডেল ষ্টিমার এ ২১ ঘন্টার রিলেক্স ট্যুরে আপনাদের স্বাগতম।

ধীরে ধীরে লেপচা ভিড়ছে ঝালকাঠি ঘাটে

সপ্তাহে ৪ দিন শনিবার, রবিবার, মঙ্গলবার ও বুধবার ( বুধবার দিনেরটা মংলা হয়ে খুলনা পর্যন্ত যায়) সন্ধ্যা ৬.৩০ এ প্যাডেল ষ্টিমার গুলো ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়। এই ট্যুরে আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। পাভেল বাদে সবাই এরই মধ্যে ঘাটে চলে এসেছি। ঘড়িতে ৬.৩০ বাজতে মাত্র ২ মিনিট বাকি। প্যাডেল ষ্টীমার আবার সরকারি লোক এক মিনিটো দেড়ি করার নয়। আমার চোখে মুখে চিন্তার ঘনঘটা, ঠিক তখনি প্লাটুন দিয়ে ভিড় ঠেলে দৌড়ে আসছে পাভেল । ষ্টীমারে উঠে চিন্তার নিশ্বাস ঝেরে ফেলতেই হুইসেল বাজিয়ে ব্যস্ত নগরীকে বিদায় জানালো শতশত সোডিয়াম লাইটের আলোকতা বিহীন কমলারঙ এর শতবর্ষী প্যাডেল ষ্টীমার লেপচা। এবার তাকে পাড়ি দিতে হবে ৭-৮ টি জেলা, প্রায় ১৫ টি নদী।

সদর ঘাটের লালকুঠির ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে প্যাডেল ষ্টীমার পি এস লেপচা

ষ্টিমারের দোতলার পেছনের দিকে নন এসি কেবিন, মাঝখানে ডেক শ্রেণি, সামনের দিকে এসি কেবিন এবং একেবারে সামনে ভিআইপি ডেক। ভিআইপি ডেকটা মুলতো ষ্টিমারের সামনের অংশ, কিছু চেয়ার রাখা আছে, তিন দিকে ফাকা। এখান থেকেই ভ্রমনের বেষ্ট ভিউ পাওয়া যায়। ডেকের যাত্রি দের এখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। আমরা কেবিনে ব্যাগ রেখে প্রথমে চলে আসি ভিআইপি ডেকে বুড়িগঙ্গার দুই তীরের সৌন্দর্য অবলোকন করতে। ও হ্যাঁ বলে রাখি আপনারা যদি কেউ কেবিনে ভ্রমণ করতে চান তবে অবশ্যই অগ্রিম টিকেট কেটে রাখবেন। এসি কেবিনের টিকেন বাংলামটরে অবস্থিত “BIWTC” এর অফিস থেকে এবং নন এসি কেবিনের টিকেট সদর ঘাট থেকে অথবা অনলাইনে sohoz.com থেকে কাটতে পারবেন। ঢাকা থেকে মোড়লগঞ্জ পর্যন্ত ভাড়া: ডেক ২৮০ টাকা, ফার্স্ট ক্লাস এসি কেবিন ৩৭১৫ টাকা (দুই বেড), সেকেন্ড ক্লাস নন এসি ২১০০ টাকা (দুই বেড)।

ঐতিহ্যময় এই বাহনের খাবারেও রয়েছে সুখ্যাতি। এখানের কেন্টিনের খাবার খেতে হলে আগে অর্ডার দিতে হয়। অর্ডার দেয়ার পর রান্না করে দেয়। তাই আমরা সন্ধ্যা ৭ টার সময় রাতের খাবারের অর্ডার করি। মেনু সিলেক্ট করি এখানকার বিখ্যাত খিচুড়ি। আর রাতের খাবার খেয়ে সকালের জন্যও অর্ডার করে রাখি।

বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে নারায়নগঞ্জ কে বামে ও মুন্সীগঞ্জ কে ডানে রেখে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে লেপচা চলে এসেছে মেঘনায়। মেঘনার নির্মল বাতাস গায়ে মেখে ভাঙ্গা চাঁদের ক্ষয়িষ্ণু আলোয় মেঘনার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলুন জেনে নেই প্যাডেল ষ্টিমারের ইতিহাস।

সারা বিশ্বে অল্প কয়েকটি পেডেল স্টিমার এখনো টিকে আছে, যার মধ্যে বাংলাদেশেই আছে ৪ টি। পি এস লেপচা, পি এস টার্ন, পি এস মাসহুদ, পি এস অস্ট্রিচ। ইতিমধ্যে বয়সের ভারে অস্ট্রিচ বহর থেকে বিদায় নিয়েছে। এখনো টিকে আছে মাসহুদ, লেপচা ও টার্ন। এর মধ্যে ‘মাসহুদ’ ও ‘অস্ট্রিচ’ ষ্টিমার দুটি তৈরি হয়েছিল যথাক্রমে ১৯২৮ ও ১৯৩৮ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ ওয়ার্কশপে। প্রায় শত বছর ধরে এগুলো চলাচল করছে। ব্রিটিশ শাসনামলে এগুলো ঢাকা-বরিশাল, বরিশাল-গোয়ালন্দে যোগাযোগ রক্ষা করত। এই স্টিমার গুলো কয়লার দ্বারা উৎপাদিত স্টিমে চলত বলে এগুলোকে ষ্টিমার বলা হতো। পরবর্তীতে এগুলোকে ডিজেলে রুপান্তরিত করা হয়। এক সময় এটিই ছিলো সবচেয়ে গতিসম্পন্ন তাই এটিকে ডাকা হতো রকেট ষ্টিমার। ব্রিটিশ প্রিয়োডে নদী পথে দাপিয়ে বেড়ানো এই ষ্টিমার গুলো পাকিস্তান প্রিয়োড পাড়ি দিয়ে এখনও স্বাধীন বাংলাদেশে চলাচল করছে।

ঘাটে প্যাডেল ষ্টীমার ( ছবিটি নেট থেকে নেয়া)

রাত ১০.৪৫। পদ্মাকে ডানে রেখে মেঘনা, ডাকাতিয়া নদীর মোহনা হয়ে ডাকাতিয়া নদীর পাশে নির্ধারিত ষ্টিমার ঘাটে প্রথম যাত্রা বিরতি করলো পি এস লেপচা। চাঁদপুর ঘাটে ষ্টিমার ভিড়তেই হুড়মুড় করে যাত্রী উঠা শুরু করলো। অনেকে আবার ভিড় এড়াতে বা আগে উঠতে জেটি ব্যবহার না করে ছোট নৌকা দিয়ে ষ্টিমারে উঠে যাচ্ছে। চাঁদপুর থেকেই সবচাইতে বেশি যাত্রি উঠলো এটাতে। ডেকে যেনো পা ফেলার জায়গা নেই। এখানকার বেশির ভাগ যাত্রিই চট্টগ্রাম থেকে মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনে চাঁদপুর এসে এই স্টিমারে করে বরিশাল, পিরোজপুরসহ দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য জায়গায় যাতায়াত করে। ঠিক ৩০ মিনিট বিরতি দিয়ে ইলিশের শহর চাঁদপুরকে বিদায় জানিয়ে লেপচার পরবর্তী গন্তব্য বরিশাল। চাঁদপুর থেকে ছেড়ে লেপচা এখন ভাসছে মেঘনার বিশাল বুকে যেখানে দৃষ্টি সীমানায় শুধুই জলরাশি।

রাত ১২ টা। দুচোখে রাজ্যের ঘুম। ষ্টিমারের বারান্দায় কম্বল গায়দিয়ে বসে আছি। মেঘনার বুক থেকে বয়ে আসা শীতল বাতাস কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। আর এমন সময় হয়তো আপনারা ঢাকাতে গরমে হায়হুতাস করছেন। আকাশে ভাঙ্গা চাঁদের ক্ষয়িষ্ণু আলো মেঘনার জলে পরে অদ্ভুত আলো আধারের রঙ ধরান করেছে যার মাদকতা আমায় কেবিনে যেতে দিচ্ছে না।

সকাল ছয়টা। ঘুম থেকে উঠে দাঁড়ালাম কেবিনের বারান্দায়। আর লেপচা বরিশালকে বিদায় জানিয়ে কীর্তনখোলা নদী দিয়ে ঝালকাঠির পথে। মর্নিং টি হাতে সামনের ডেকে এসে দাঁড়ালাম। অপেক্ষা গাবখান চ্যানেলের। লেপচা তখন ঝালকাঠি, কাউখালী ঘাটে বিরতি দিয়ে গাবখান চ্যানেলের পথে।

লুঙ্গি আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। কি ভাবছেন ?
লুঙ্গির সাথে আবার প্যাডেল ষ্টিমারের সম্পর্ক কি? দাঁড়ান বলছি। যেহেতু এটি একটি ঐতিহ্যবাহী বাহন আর লুঙ্গি আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক তাই ভাবলাম ষ্টিমারে বাকি সময় টুকু লুঙ্গি পরেই কাটাবো। সিদ্ধান্ত মতে লুঙ্গি পরে চলে আসি ভিআইপি ডেকে। লুঙ্গি পরে ডেকের রেলিং এর পাশে ভাবনিয়ে দাঁড়ালাম নিজেকে ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করতে, পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার সাথে ছবি তোলার জন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রান্স এর প্যারিস থেকে আগত এক পর্যটক দম্পতি। আমার সাথে ছবি তোলার এক মাত্র কারণ কিন্তু আমার লুঙ্গি। কারণ তারাও জানে এটা আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। আর তাদের ঘুড়ে বেড়ানোর অন্যতম উদ্দেশ্যই কিন্তু একটি দেশের ঐতিহ্যের সন্ধান। এমন কি তিনি নিজেও পরেছিলেন অন্য একটি দেশের ঐতিহ্যবাহি পোশাক (দেশের নাম মনে নাই)। যেটা তিনি ঐদেশ ভ্রমনের সময় কিনেছিলেন।

দাঁড়িয়ে আছি সামনের ডেকে। ধীরে ধীরে লেপচা বিষখালী নদী থেকে প্রবেশ করছে গাবখান চ্যানেলে। অনেকে আবার গাবখান নদীও বলে কিন্তু এটি মূলত মানুষ নির্মিত খাল যা নেভাল র‍ুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঝালকাঠির সুগন্ধা-বিষখালীর সাথে পিরোজপুরের সন্ধ্যা নদীর সংযোগ ঘটায় ১৯১৮ সালে এটি খনন করা হয়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬ কিলোমিটার । এই খালের জন্য ঢাকা-মংলা নৌপথের দূরত্ব প্রায়১২০ কিলোমিটারের মত কমে আসে। সবুজ গাছগাছালির ভেতর দিয়ে বহমান এই চ্যানেলের সৌন্দর্য আমার মতো আপনাদেরও মুগ্ধ করবেই।

সকাল ১০.৩০। লেপচার এবার যাত্রা বিরতি হুলারহাট ঘাটে। ষ্টিমারে থাকা সকল বিদেশী পর্যটক ভ্রমণ এর ইতি টেনে এই ঘাটে নেমে গেলো। এখান থেকে সড়ক পথে খুলনার দূরত্ব কম। এদের বেশিরভাগের গন্তব্য সড়ক পথে খুলনা।

দুপুর ২.৩০, মাথার উপর সূর্য খা খা করছে। বসে আছি লেপচার ছাদে ড্রাইভিং রুমের পাশে বাড়তি জায়গায়। ড্রাইভিং রুমের ছায়ার কারনে এখানে রোদ পরছেনা। চরখালী – বড় মাছুয়া (মঠবাড়িয়া), সন্ন্যাসি ঘাটে ৩০ মিনিট করে যাত্রা বিরতি শেষে লেপচা এখন বলেশ্বর নদী দিয়ে মোড়লগঞ্জ এর পথে। এখানে নদী বেশ চওড়া। কড়া রোদের মধ্যেও শীতল বাতাস। যেন এখানে বসে কয়েক ঘণ্টা নয়, টানা কয়েক দিন ভ্রমণ করলেও কোন বিরক্তি আসবে না।

দুপুর ৩.৩০। লেপচা ধীরে ধীরে ভিড়ছে মোড়লগঞ্জ ঘাটে। আলহামদুলিল্লাহ ঢাকা থেকে ২১ ঘন্টার রিলেক্স ট্যুর শেষে আমারা এখন মোড়লগঞ্জ। হাতে গোনা কয়েকজন যাত্রি নামলো এখানে। আর সম্ভবত সরাসরি ঢাকা থেকে আসা একমাত্র যাত্রী আমরাই। এখন আমাদের বাসে করে দ্রুত ছুটতে হবে খুলনা, কারন খুলনা ষ্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে ঢাকা যাওয়ার রাতের ট্রেন সুন্দর বন এক্সপ্রেস।

বয়সের ভাড়ে হয়তো যেকোন দিন বহর থেকে ছিটকে পড়বে এই ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল ষ্টিমার গুলো। শুধু এটিতেই ভ্রমনের জন্য প্রতিদিন ছুটে আসে বিদেশী পর্যটক। সৈয়দ মুজতবা আলী, রানী এলিজাবেথ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, কে ভ্রমন করেনি এটিতে ? তাহলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে আপনি কেন নন? সিদ্ধান্ত আপনার !

(প্যাডেল ষ্টীমারে বসে নদীতে অপচনশীল পলিথিন বর্জ ফেলা থেকে বিরত থাকুন)

প্যাডেল ষ্টীমার লেপচা ১৭.৩.১৯