ট্রলারে সেইন্ট মার্টিন (পর্ব – ২)

লিখছেন : Nazmul Hossain Nadim

প্রথম পর্ব এখানে

..কোষ্ট গার্ড ওকে দেয়ার পর ট্রলার জেটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো, আর ১২ মিনিট পর ই আমরা পৌছে গেলাম কাংখিত দ্বীপে। আমাদের দেশের একটা অংশ, সেইন্ট মার্টিন দ্বীপ।

আমরা যখন দ্বীপে পৌছাই তখন প্রায় বিকেল ৪টা বাজে। নাফ নদীতে ট্রলার ২বার বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং পড়ে ট্রলার থামিয়ে আবাএ যাত্রী উঠানোয় অনেকটা দেরী হয়ে যায়। যাই হউক আমরা রিসোর্ট (ব্লু ল্যাগুন) আগে থেকেই বুক দিয়ে রেখেছিলাম তাই তাদের একজন কর্মকর্তা জেটিতে ছিলেন আমাদের রিসিভ করার জন্য। আমরা ভ্যানে রিসোর্টে পৌছাই, রিসোর্ট কিছুটা ভিতরে থাকায় ১০০ টাকা করে ভাড়া চাচ্ছিলো, পরে ৫০টাকা করে ২টা ভ্যান ভাড়া করে রিসোর্টে পৌছাই।
রিসোর্টে পৌছেই মনটা ভালো হয়ে যায়, কেননা রুমের পরিবেশ বেশ ভালো ছিলো। তারপর সবাই ফ্রেশ হয়ে সাগড় পাড়ে যাবার জন্য বের হই, কিন্তু ক্ষুধা প্রচন্ড থাকায় আমরা রিসোর্টে ই কোরাল মাছ দিয়ে একেবারে ডিনার টা সেরে নেই ( কেননা খাবার অর্ডার করার পর আসতে আসতে প্রায় ৬টা বেজে যায়। ) ।
এরপর সূর্যাস্ত দেখতে বের হই। মজার ব্যাপার হচ্ছে রিসোর্ট এর সামনে থেকেই সূর্যাস্ত খুব ভালো ভাবে উপভোগ করা যায়, এজন্য রিসোর্ট কে ৫ তারকা দেয়াই যায়। তখন ভাটার সময় ছিলো বলে সমুদ্রের অনেকটা মাঝেই গিয়েছিলাম, জোয়ারে যেখানে যাওয়ার কথা ভাবাই অসম্ভব। অতঃপর ঘুটঘুটে অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে হেটেছি। আগে থেকে গুজব শুনেছিলাম যে, অফ সিজনে ডাবের দাম কম থাকে, তাই রিসোর্টে ফিরে ডাব দেখে দাম জিজ্ঞেস করলাম, চাইলো ৩০ টাকা করে, বললাম ১০ টাকা করে দিবো। পরে অনেক দামাদামির পর ২০ টাকায় ফিক্সড হলো। সবাই ইচ্ছেমতো ডাব খেয়েছে, একেক ডাবে প্রায় ৩গ্লাস করে পানি হতো। আসার সময় বিল হিসেব করে ৫০০ টাকা দিয়েছিলাম। ৮ জনে সম্ভবত ২৪ টা খেয়েছিলাম। ডাব খেয়ে রিসোর্টের বসার জায়গা গুলোতে সবাই প্রায় রাত ১২ টা পর্যন্ত আড্ডা মেরেছিলাম। এরপর সবাই ঘুমের দেশে।

পরদিন সকালে ৪.৩০ এ উঠে ৫টার দিকে পূর্ব সমুদ্রপাড়ে চলে গেলাম সূর্যোদয় দেখতে। সূর্যোদয় দেখা হলো, ছবি তোলা হলো।। এরপর বাজারের দিকে চলে গেলাম নাস্তা করতে। পরোটা আর ডাল-ভাজি সাথে ডিম নিয়েছিলাম। বিল এসেছিলো ৪০০ টাকা। এরপর ফাকা দ্বীপ টা চষে বেড়াই সবাই। জেটির বামের বীচ ধরে অনেক টা ঘুরে বেড়াই। তারপর এই সমুদ্রের তীর ধরে হেটে হেটে আমরা রিসোর্টে পৌছাই। সবাই ফ্রেশ হয়ে সুরমা মাছ দিয়ে লাঞ্চ করে কিছুক্ষন বিশ্রাম করে বেড়িয়ে পড়ি ছেড়াদ্বীপ এর উদ্দেশ্যে। সাথে মেয়ে সদস্য থাকায় কিছুটা সঙ্কায় ছিলাম, পারবে কিনা। প্রায় দেড় ঘন্টা হেটে আমরা আমাদের কাঙ্খিত ছেরাদ্বীপে পৌছাই। ছেড়াদ্বীপের একেবারে শেষ প্রান্ত, যেটাকে আমি বলি বাংলাদেশের শেষ প্রান্ত, সেখানে চলে যাই সবাইকে নিয়ে। সেখানে যাবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর আগে যখন গিয়েছিলাম তখন ওয়ি জায়গা টা খুজে পাই্‌ যেখানে আপনি ঢেউ এর অনুভূতি টা সম্পূর্ন নিতে পারবেন এবং সম্পূর্ন সেইফ ও। ওয়ি জায়গা টা তে পৌছাতে কোরালের উপর দিয়ে হাটতে হয়েছিলো প্রায় ১৫-২০ মিনিট। একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবেন, পা যেন পিছলে না যায়, কারন কোরাল গুলো ধারালো খুব, একটু স্লিপ করলেই ছিলে বা কেটে যায়।
ওই সেইফ জায়গা টা তে গিয়ে সবাই নেমে পড়ি সমুদ্রস্নান করতে। ওইদিন ঢেউ গুলো একটু বেশীই বেপরোয়া ছিলো হয়তো। অনেক বিশাল বিশাল ঢেউ আসছিলো, কিন্তু ওয়ি যে, জায়গা টা সেইফ ছিলো তাই কোন ভয় লাগছিলো না। ছেলেদের মধ্যে ২জন সাঁতার জানতো না, তারাও উপভোগ করা থেকে পিছিয়ে ছিলো না। একেক টা ঢেউ এর সামনে সবাই বুক দিয়ে দাড়াতাম, আর ঢেউ এসে ধড়াম করে ফেলে দিতো। এই সময় আমরা পিছলে একটু পেছনের দিকে পড়ে যাই সবাই ই… তবুও সম্পূর্ন মজা নিচ্ছিলাম। সবার ই হালকা পাতলা ছিলে গিয়েছিলো; যেটা টের পেয়েছিলাম রুমে এসে যখন শাওয়ারে গিয়েছিলাম। তবুও উত্তাল ঢেউ, তার গর্জন, নীল আকাশ…এসব সৌন্দর্যের কাছে এসব ব্যাথা খুবই ফিকে লেগেছিলো।
ওদিকে একটা কোরাল কে নামার সময় থেকেই চোখে রাখছিলাম, যদি এটা পানির নিচে চলে যায় তবে আমরা উঠে যাবো, কারন তখন ধীরে ধীরে জোয়ার আসার সময়। যদি জোয়ারে আটকে যাই তবে আর সেইন্ট মার্টিনে যাও্যা সম্ভব না, সেখানেই থেকে যেতে হবে।
সমুদ্রস্নান শেষ করে সবাই ফিরে আসলাম। ছেড়াদ্বীপেই সূর্যাস্ত দেখলাম। অতঃপর পায়ে হেটে আবারো মেইন বাজারের উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা দিলাম। প্রায় ৮ টা নাগাত আমরা পৌছাই বাজারে। সবার সাথেই ফোন ফোন ছিলো, আর ফোনে টর্চলাইট ছিলো, তাই অন্ধকার হইয়ে গেলেও খুব একটা সমস্যা হয়নি। কিন্তু আসার পথে একজন হঠাত চিৎকার করে বলে উঠলো, সবাই ফোনের টর্চ টা বন্ধ করে আকশের দিকে তাকাও।
বিশ্বাস করুন, সারাটা জীবন মনে রাখার মত একটা দৃশ্য ছিলো। সারা আকাশ জুড়ে তারা, তার প্রতিফলন সাগরের পানিতে, আশেপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার; দূরে বাংলাদেশ নেভীর জাহাজের আলো জ্বলছিলো। অনুভূতি টা হয়তো প্রকাশ করতে পারছি না সম্পূর্নরুপে, তবে আমার ইচ্ছে থাকবে আমার শত্রু ও যেন এমন একটা রাতের সাক্ষী হয়।
আমাদের ইচ্ছে ছিলো কোরল মাছের বারবিকিউ খাবো, কিন্তু অফ সিজন তার উপর দিন টা ছিলো শুক্রবার, মানে শুক্রবার গরু জবাই হয়, তাই জেলেরা নাকি মাছ ধরতে যায় না; তাই আর খাওয়া হলো না বারবিকিউ। এমনকি বাজারের কোন হোটেলেও কোন মাছের আইটেম পেলাম না। অতঃপর বাধ্য হয়ে ফার্মের মুরগী দিয়ে ডিনার সেরে রিসোর্টে চলে গেলাম। আবারো আরেক রাউন্ড ডাব খাওয়া হলো, মাঝরাত পর্যন্ত সমুদ্রের গর্জন শোনা, ঝড়ো বাতাস উপভোগ করা্‌ তারপর ঘুম।

পরদিন একটু বেলা করেই(৮ টা নাগাত) সবাই উঠলো, ফ্রেশ হয়ে, রেডি হয়ে সবাই বের হলাম। রিসোর্ট থেকে চেক আউট করলাম।
২ দিনের ২ রুমের(প্রতি রুমে ৪জন ঘুমোতে পারবে) ভাড়া ২০০০ টাকা। আর ২ বেলার খাবার( কোরাল আর সুরমা) বিল আসলো ২৫০০ টাকা। বিল মিটিয় চলে গেলাম জেটির কাছাকাছি। গিয়ে প্রথমে ট্রলারের টিকেট কনফার্ম করে সকালের নাস্তা টা সেরে নিলাম। নাস্তা বিল এবারো ৪০০ টাকা আসলো, আর ট্রলারের ১৭৪০ টাকা।
এমন সময় প্রকৃতি বেকে বসলো, তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। সবাই মোটামুটি ভয় পেয়ে গেলাম, এই অবস্থায় যাবো কি করে? কিছুক্ষন পর দেখি যাত্রীরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে ট্রলারে উঠে যাচ্ছে, তখন একজন বললো, আমাদের ও উঠা উচিত, না হয় পরে জায়গা পাবো না। কি আর করা, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রলারে। বৃষ্টি, কালো মেঘলা আকাশ দেখে সবাই বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখলাম কোষ্ট গার্ড ও দাঁড়িয়ে আছে এবং উনি গুনে গুনে যাত্রী উঠিয়ে দিয়েছেন, যা দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কেননা ভয়ের কিছু থাকলে তারা কখনোই ট্রলার ছাড়ার অনুমতি দিতো না।

অতঃপর ট্রলার ছাড়লো টেকনাফ এর উদ্দেশ্যে, ১০ মিনিট চলার পর চারপাশের পরিবেশ দেখে এবার আমি নিজেই অনেক টা ঘাবড়ে গেলাম। অর্ধ বৃত্তের মতো চারপাশে কালো মেঘ হয়ে আছে, ঝড়ো বৃষ্টি, উত্তাল সাগড়, সাথে অনেক বড় বড় ঢেউ। কোন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না মাঝি, আমি কয়েকবার তার চেহারায় উতকন্ঠার ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম। আমি একবার ভেবেও নিয়েছিলাম, যদি ফিরতে পারি তবে এটা একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে; না হয় সলিল সমাধি। মাঝি কোন দিক না পেয়ে একদিকে চালিয়েই যাচ্ছিলো। এমন সময় পেছনে একটা ট্রলারের আবির্ভাব ঘটে, ওরা আমাদের ট্রলার কে থামাতে বলে। সবাই ই বেশ ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলো, কারন আশেপাশে আর কোন ট্রলার ছিলো না, মানুষের চিহ্ন ত না ই। সবাই ভাবলো জলদস্যুর হাতে কি তবে…??
সবাই মাঝিকে ট্রলার থামাতে বারন করছিলো। মাঝির চেহারাও কেমন ফ্যাকাশে দেখলাম। ওয়ি ট্রলারের স্পিড বেশী থাকায় ওরা আমাদের পাশাপাশি চলে আসলো। তারা জিজ্ঞেস করছিলো, সেইন্ট মার্টিন কোনদিকে? তারা নাকি চট্টগ্রাম থেকে এসেছে, দিক হারিয়ে ফেলেছে। মাঝি নির্দেশনা দিয়ে দিলো, ট্রলার উলটো দিকে ঘুরিয়ে নিলো। এদিকে মাঝি এখনো কোন দিক খুজে পাচ্ছিলো না, কোনদিকে যাবে বা যাও্যা দরকার, কারন কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। সাথে উত্তাল সমুদ্র আর বড় বড় ঢেউ এ ট্রলার কখনো ডানে কখনো বামে এতটাই কাত হয়ে যায় যে, ভাবতে বাধ্য হয়েছি- এই বুঝি ডুবে গেলো। ২ টা ঢেউ খুবই ভয়ানক ছিলো, এতটা উপরে উঠিয়েছিলো ট্রলার, আর সাথে সাথে ইঞ্জিন ও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। পরে আর কি, ধপাশ করে পড়েই ডানে কাত হয়ে গেলো, এমনভাবে কাত হয়েছিলো যে, আমি কাঠ শক্ত করে ধরে নিয়েছিলাম যেন, মাত্রই ডুবতে চললো, আর হলিউড মুভির নায়কের মত আমি কাঠ ধরে সুমুদ্র জয় করে বাড়ি ফিরবো।

এভাবে চলতে চলতে হঠাত করে সামনে কিছুটা দেখা যায়, আর মাঝি হঠাত করেই এমন করে ট্রলার টা বামে টার্ন নেয়, যা রেসিং কার গুলো করে থাকে। পরে মাঝিকে জিজ্ঞেস করায় বলে, আমরা মায়ানমার সিমান্তে চলে গিয়েছিলাম। ওদিকে ওয়ি ট্রলার টা কিছুক্ষন পর দিক ঘুরিয়ে আমাদের পিছু নেয়, যা কিছুক্ষন পরপর ঘাড় বাকা করে দেখছিলাম আর ভয় পাচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে চলতে চলতে আমরা বাঙ্গলাদেশ অংশ দেখতে পাই, আর সবার মুখেই একটা হাসি দেখতে পাই। এই হাসি গুলো আমায় অনেক টাই স্বস্তি দিয়েছিলো।
এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মাঝে ২ জন নারী কে দেখলাম বমিও করে দিয়েছিলো।। 😑

অবশেষে আমরা যখন নাফ নদীর প্রথম জেটিতে পৌছালাম(যাত্রী নামার ছিলো, বিজিবি চেক করছিলো সবাইকে), পেছনে তাকিয়ে দেখি ওয়ি ট্রলার তার দিক পরিবর্তন করে অন্যদিকে যাচ্ছে। তার মতলব ট ঠিক বুঝে উঠতে পারে নাই কেউ ই। এই জেটি থেকে যখন টেকনাফের দিকে যাচ্ছিলো, তখন মনে হয় বৃষ্টির রাগ আরো বেড়ে গিয়েছিলো, এতটাই বৃষ্টির তেজ আর বাতাসের জোড় যে, কাপুনি চলে আসছিলো। ফাইনালি, আমরা ঘাটে পৌছাই আর একটা রোমাঞ্চকর ভ্রমন/অভিজ্ঞতার যবনিকা ঘটলো।
সবাই ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম বলে, একটা হোটেল এর ২ টা রুম ভাড়া নিয়ে সবাই ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে চেক আউট করে ফেলি। তারপর হুন্দাই গাড়ি ভাড়া করে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজার এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।
(সে গল্প না হয় অন্যদিন শেয়ার করবো। আপনারা সেই অভিজ্ঞতার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী হলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন; তাহলে খুব দ্রুতই শেয়ার করার চেষ্টা করবো।

২৯ তারিখ যাত্রা করে ৪ তারিখ সকালে আমরা ঢাকায় পৌছাই, এর মধ্যে সেইন্ট মার্টিন ও কক্সবাজার কাভার করি। মোট ৮ জন সদস্যের খরচ হয়েছিলো ৪১,৬৮৫।
মাথাপিছু মাত্র- ৫৫১৬ টাকা।

#যেখানেই ঘুরতে যান, পরিবেশ নষ্ট করবেন না যত্রতত্র ময়লা ফেলে। ময়লা যথাস্থানে ফেলুন, পর্যটন জায়গা গুলো পরিষ্কার রাখুন। দেশ আমাদের, এর সম্পদ ও আমাদের; তাই রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমাদের ই। #

সেইন্ট মার্টিন ভ্রমন নিয়ে ছোট্ট একটা ভিডিও বানিয়েছি, ভালো ফরমেটে দেখতে ক্লিক করুনঃ https://www.youtube.com/watch?v=5XPgQIrhp5E