নীল পরীদের দেশ

নীল পরীদের দেশ

লিখেছেন : Ashik Sarwar

 

অধ্যায় একঃ দূর্যোগের ঘনঘটা

মা’র মুখে ছোটবেলায় শুনতাম নীল পরীর গল্প৷ মা’র সেই ছেলে ভুলানো গল্পে চলে যেতাম কল্পনার রাজ্যে। পংখীরাজ ঘোড়ায় চড়ে শুভ্র মেঘমালা ভেদ করে হাওয়ার তালে চলতো আমার সপ্নতরী। যখন এই জিজ্ঞেস করতাম আম্মু কবে নিয়ে যাবে নীল পরীদের দেশে। মা তখন মায়াভোলা হাসি দিয়ে বলতো, সোনা তুমি তো অনেক ছোট যখন অনেক বড় হবে তখন নীল পরীর দেশে যেতে পারবে৷ নীল পরীর দেশে আছে মস্ত বড় ভাউ, বাবুদের দেখলে মস্ত বড় হা করে গিলে ফেলে। নীল পরীর দেশে যেতে হলে পাড়ী দিতে হয় সাত সমুদ্র তের নদী। ডলফিনের পিঠে চড়ে যেতে হয় সে দেশে। আমার আব্বুটা যখন বড় হবে তখন নীল পরীর দেশে যাবে। ঘুমাও সোনা৷ কত রাত কেটেছে আমার নীল পরীর দেশের সপ্ন দেখে৷ নীল নীল জলরাশি কেটে কেটে ডলফিনের পিঠে চড়ে যাচ্ছি নীল পরীর দেশে৷ কত দিন গিয়েছে আমার ভেবে আচ্ছা নীল পরীর দেশটা কেমন হবে। ওখানে কি মানুষ আছে৷ মানুষ গুলো কি কোন দুষ্টু দৈত্যের কাছে বন্দী। নীল পরী ওদের উদ্ধার করবে??

শৈশব ডানপিটে দিন গুলা পার করে এক সময় দূরন্ত কৈশোরে প্রবেশ করলাম৷ ততদিনে ভুলে গেছি সেই নীল পরীর দেশের গল্প। সময় চলে যায় সময়ের স্রোতে৷ তখন আমার স্কুল পালানোর দিন। রাকিব, আইয়ান, জোভান, মাক্স ছিল আমার পার্টনার ইন ক্রাইম৷ তিন গোয়েন্দার গল্প পড়ে সবাই এডভেঞ্চারের জন্য ব্যাকুল৷ সদ্য স্কুল পাস করে কলেজে উঠা টগবগে কিশোর। এই বয়সটা খারাপ গুরুজন বলে৷ তবে তখনকার দিনের টেকনোলজি ছিল না এত এডভান্স। মেয়েদের পাশে বসে পরীক্ষা দেওয়া, একটু চোরা চোখে চাওয়া, ধরা পড়লে আবার সেই প্রশয়ের খিল খিল হাসির গুঞ্জন এখনও কানে বাজে৷ এখন জেনারেশ গ্যাপের ফাদে পড়ি ভাবি ছেলে মেয়ে গুলো কত এডভান্স মাইরে৷ কঠিন সেই কনজারভেটিভ যুগে ৫ জন কিশোর বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে, গল্পের ফুলঝুরি শুনিয়ে কোন মতে রাজি করালো কক্সবাজার যাবার ব্যাপারে। আহা মনে কি আনন্দ। কেউ জানে না তাদের সেন্ট মার্টিনের গোপন বাসনার কথা। তখন কেয়ারী এই রুটে নতুন নতুন আসছে। কিন্তু এপ্রিল মাসের কাল বৈশাখীর এই উত্তাল সিজনে তার চলার সম্ভবনা একেবারে নেই বললেই চলে। তাই টেকনাফ থেকে ট্রলারে শুরু হল আমাদের এডভেঞ্চারের যাত্রা।

নাফ নদীর জলরাশি কেটে কেটে যাচ্ছে আমাদের ট্রলার। চারদিকে নদী পাহাড়ের এক অপূর্ব মিলন মেলা। দূর দিগন্তে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের বে অফ বেংগল। মায়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে যেন এক অলিখিত বর্ডার এই নাফ নদী। টারকুইশ আর নীল পানির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে এই কিশোর মন। ট্রলারের চালক রহিম মিয়া আমাদের ব্রিফিং দিচ্ছে৷ দূরে দেখা যাচ্ছে একটা জেটিঘাট। রহিম মিয়া বলে উঠলো এসে পড়েছি শাহ পরীর দ্বীপ৷ কিংবদন্তি বলে মীর জুমলার ধাওয়া খেয়ে শাহ সুজা তার স্ত্রী পরী বানু এই দ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছিল তখন থেকে এই দ্বীপের নাম শাহপরী৷ স্মৃতি ঝালাই করে যতটুকু মনে পড়ে তখন জেলেপাড়াটা সাগরের কিনার ঘেষে ছিল৷ ঘাট থেকে দেখতে পারলাম জেলেদের সমুদ্রের সাথে রক্তচক্ষুর খেলা। শাহ পরীর দ্বীপে কিছু মানুষ নামিয়ে আবার শুরু হল আমাদের যাত্রার। এর মধ্যে দেখতে পারলাম আকাশটা ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। সো সো করে বাতাস বইছে সাগরে৷ দূর্যোগের ঘনঘটা আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে।

এর মধ্যে ট্রলার ঢুকে পড়লো বে অফ বেংগলে৷ কাল বৈশাখীর ঝড় শুরু হয়ে গেল সমুদ্রে ঢোকার সাথে সাথে৷ দিনের বেলায় যেন রাতের আধার নেমে এল সমুদ্র৷ আমাদের পাচজনের আত্মারাম কেপে উঠলো৷ কূল কিনার দেখা যাচ্ছে না। বড় বড় ঢেউ এর তালে দুলছে আমাদের ট্রলার। ঢেউ এর সাথে উপরে উঠছে আর নিচে নামছে৷ মায়ের বলা সেই ছোট বেলার গল্পের নীল পরীর দেশের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল৷ সাগরের উত্তাল ঢেউ গুলা যেন সেই ভাউ এর মত আমাদের প্রতিনিয়ত গিলতে আসছে। আর ট্রলার কে মনে হচ্ছে আমার সেই ডলফিন যে আমাকে নিয়ে যাবে নীল পরীর দেশের পানে৷ জীবনে প্রথম মৃত্যু কে এত কাছে থেকে দেখলাম। আয়তুল কুরশী, দোয়া দরুদ পড়তে লাগলাম সবাই। এত রোলিং এর মাঝে আমি আল্লাহ’র স্মরনে চলে গেলাম। মনে মনে ভেসে উঠলো প্রিয় সব মুখ। রহিম মিয়ার মুখে এক চিলতি হাসি দেখে আমরা সবাই একটু অবাক হয়ে গেলাম। আমি বিরক্তি হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম এই দূর্যোগের ভিতরেও আপনি কি ভাবে হাসছেন। রহিম মিয়া জবাব দিল এই সমুদ্র কারও লাশ গ্রহণ করে না। এখানে ট্রলার ডুবে না বড় দূর্যোগেও। বুকে একটু সাহস যেন ফিরে পেলাম। ১০-১২ মিনিট যেন এক যুগের মত কেটে গেল। যেমন হঠাৎ করে তার অর্বিভাবে তেমনই হঠাৎ করে তার প্রস্থান। দেহ আর চাপ নিতে পারলো না। বমি করা শুরু করলাম। নিজেকে অনুভূতি শূণ্য মনে হতে লাগলো।কতক্ষন উত্তাল সাগরে আমাদের ট্রলার এভাবে চললো বুঝতেই পারলাম। হঠাৎ রহিম মিয়া ডাকে ঘোরের জগৎ থেকে ফিরে এলাম। ছোট বাবু সাহেব ওই দেখেন সেন্ট মার্টিন দেখা যায়। আহা সেন্ট মার্টিন এই তো আমার নীল পরীর দেশ।

অধ্যায় দুইঃ আকাশ জুড়ে নক্ষত্রপুঞ্জ

দূর থেকে দেখা যায় সেন্টমার্টিন৷ অন্তহীন সমুদ্রের বুকে যেন জেগে উঠা এক দ্বীপ৷ জাহাজ যত জেটিঘাটের কাছে আসলো ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে লাগলো নারিকেল গাছের সারি, বড় বড় নৌকা, স্থানীয় জনপদ৷ জেটিঘাটে আমাদের ট্রলার ভেড়ানোর সাথে সাথে আমরা হুড়োহুড়ি করে নেমে পড়লাম। এতক্ষনে যেন জানে পানি আসলো। পুরা দ্বীপে আমরা ৫জনই পর্যটক। সুনসান নিরবতার মাঝে হেটে যাচ্ছি আমরা। দিনের শেষ সূর্যের আলোয় চিক চিক করছে বালুকাময় সমুদ্র সৈকত৷ দূরে দেখা যাচ্ছে জেলেদের মাছ ধরার ট্রলার দিনের শেষে নিড়ে ফিরে আসছে৷ সাগরের নীলাভ জলরাশির সাথে পিছনের নারিকেল গাছের সাড়ি এই দ্বীপ কে দিয়েছে আপার্থিব সৌন্দর্য্য৷ হারিয়ে গেলাম আমার ছোট বেলার সেই নীল পরীর ভুবনে৷ যতদূর চোখে যায় শুধুই সমুদ্র৷ ওপরে সচ্ছ নীল আকাশ৷ আকাশটা যেন মিশে গেছে সমুদ্রের জলে এক অদ্ভূত নীলের নীলিমায়৷ নীল আকাশের থেকে বেশি নীল এই জলরাশি৷ এক মূর্হুতের জন্য মনে হল আম্মা তো ভুল বলে নাই। বাস্তবে যদি কোন নীল পরীর দেশ থাকতো তাহলে হয়তো তার রূপ এ রকমই হত৷

জোভান, মাক্স স্কাউট করার সুবাদে প্রতিকূল পরিবেশে কি ভাবে ক্যাম্পিং করে থাকতে হয় আগে থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত। ঢাকা থেকে আমরা শুকনা খাবার নিয়ে নিয়েছিলাম৷ এবার তাবু পিচ করার পালা৷ বিচের পশ্চিম দিকে তাবু পিচ করার জন্য বেছে নিলাম। ঢাকা থেকে ঢাউস সাইজের এক তাবু কোথা থেকে যেন ওরা জোগাড় করে নিয়ে এসেছিল৷ লিডারদ্বয়ের দেখানো পথে আমরা সুন্দর ভাবে তাবু পিচ করে ফেললাম৷ ভিতরে ঢুকে যার যার মালপত্র রেখে সাথে আনা স্লিপিং ম্যাট গুলো বিছিয়ে নিলাম৷ মাথার কাছে বালিশ হিসাবে রাখলাম নিজেদের ব্যাকপ্যাক গুলো। সব শেষে ক্যাম্প ফায়ারের কাঠ জোগাড়ের জন্য আমরা স্থানীয় বাজারে গেলাম ৩ জন৷ বাকি ২ জন তাবু পাহারার কাজে নিয়োজিত হল। বাজার থেকে কাঠ আনার পর যথারীতি ক্যাম্প ফায়ারের কাজে সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল৷ স্কাউটের গানের তালে তালে কাজের একটা মৃদু ছন্দ এসে গেল।

ক্যাম্প ফায়ার ক্যাম্প ফায়ার
আজ আমাদের ক্যাম্প ফায়ার
ক্যাম্প ফায়ার………………………।

দাউ দাউ করে দেখ দাবানল জ্বলছে
মৌ মৌ মৌ লোভে কাব স্কাউট ছুটছে
স্কাউটের আলোতে দূর হবে অন্ধকার।
ক্যাম্প ফায়ার………………………।

আগুনের শিখা দেখ উর্ধ্ব আকাশে
শিশু মনের আশা জাগে তারই পরশে
নির্ভয়ে এসো ভাই মিলি এক জায়গায়
পেম-প্রীতি ভালোবাসা মিলনের গান গাই।

দাওমুছে হৃদয়ের হিংসা অহংকার
ক্যাম্প ফায়ার……………………।

সব কিছু আয়োজন হলেও রান্না করা বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার বিধায় ঠিক করা হল লোকাল হোটেল থেকে কিনে খাব৷ আস্তে আস্তে ঘনিয়ে এল রাতের আধার। সি বিচে ওয়াল ক্লথ বিছানোর পর এলিয়ে দিলাম এই দেহ। সৃষ্টি রহস্যের মায়াজালে যেন নিজেকে ছেড়ে দিলাম। রাতের আকাশের মায়া ভরা চাদের আলো যেন গলে গলে পড়ছে আমার দেহে। সাথে নক্ষত্র ভরা আকাশ যেন এক আপার্থিব সৌন্দর্য্যের হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়। এত উজ্জ্বল রাতের আকাশ আমি আমার এই ছোট জীবনে কবে দেখেছি মনে করতে পারি না। আকাশটা যেন নক্ষত্র সুশোভিত বাগান৷ সেখানে ফুটে আছে লক্ষ লক্ষ তারার মেলা। আমি যেন পাল ছাড়া এক নৌকার নাবিক। ঘরে বেধেছি আজ এই সমুদ্র সৈকতে লক্ষ লক্ষ তারার মাঝে৷ বে অফ বেংগলের বুনো গর্জন কর্ণকুহরে সংগীতের মত বাজে। এর মধ্যে আমাদের মধ্যে জ্ঞান পাপী আইয়ান নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে লেকচার দেওয়া শুরু করলো। বিশ্ব ভূখন্ড মহাশূণ্যের অসীম গভীরতার মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে এই নক্ষত্রপুঞ্জ। এই তারার সমাবেশের মাঝেই আমাদের খুজে নিতে হবে সেই রুপকথার ফিনিক্স পাখি। উত্তরে আকাশে দেখলে হয়তো পাওয়া যাবে পেগাসাস। বাংলায় যার নাম পক্ষীরাজ ঘোড়া। পক্ষীরাজ ঘোড়ার সবচেয়ে বড় নক্ষত্রটি সূর্য থেকে ১২ গুণ ভারী। আইয়ানের কথায় ফিরে গেলাম আমার সেই ছোট বেলার সপ্নে। পক্ষীরাজ ঘোড়া করে আমি উড়ে বেড়াচ্ছি নীল আকাশের এক অসীম দিগন্তে৷ আহা আমার নীল পরীর দেশ৷ উরসা মেজর বাংলায় যার সপ্তর্ষি মন্ডল। সপ্তর্ষি মন্ডলের সবথেকে দৃশ্যমান প্যাটার্ন হল, সাতটি উজ্জ্বল তারা মিলে একটি ভালুকের আকার ধারণ। মহাজ্ঞানী টলেমি সেই দ্বিতীয় শতাব্দীতে আবিষ্কার করেন এই সপ্তর্ষি মন্ডল৷ আইয়ানের মন মুগ্ধকর কথা মাঝে সবাই মনমুগ্ধ ছিলাম৷ এর মাঝে খেয়াল করলাম আকাশ থেকে তারা খসে পড়েছে৷ আমাদের মুগ্ধতা বিস্ময়ে পরিণত হল। হে বিধাতা কত সুন্দর তোমার এই আকাশ। বিলিয়ন স্টার হোটেলে আমি যেন এক হাওয়ায় পাওয়া মানুষ।
অধ্যায় তিনঃ নীল বেদনায় নীলাম্বরী

খুব ভোরে বে অফ বেংগলের গর্জনে ঘুমটা ভেংগে গেল। তাবুর ফাক দিয়ে মাথাটা গলিয়ে বিস্ময়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। নীল সাগরের ঢেউয়ের কোলে ভাসছে জেলেদের নৌকা গুলো। মাতালী হাওয়া বইছে চারদিকে৷ এত সকালে সাগর পাড়ে খেলা করতে দেখলাম কিছু সাগর কন্যাদের৷ যেন কোন দেব শিশু নেমে এসেছে এই ধরণীর কোলে৷ মন ভুলানো এই পরিবেশে নিজেকে বেধে রাখা দেয়। প্রবাল দ্বীপের জন্য বিখ্যাত এই দ্বীপে প্রবালই দেখা হল না। সবাই কে ডেকে উঠলাম৷ তাবু গুটিয়ে সবাই রেডি হলাম। সৈকতের পশ্চিম দিকে প্রবালের দেখা যেতে পারে শুনে আমরা সবাই সে পথে পা বাড়ালাম৷ গন্তব্যে এসে মনেটা ভরে গেল অসংখ্য প্রবালের সারি এক সাথে মিলেমিশে একাকার৷ অদ্ভূত এক নির্জনতার মাঝে সাগরের সাদা সাদা শুভ্র ফেনা প্রবালে আছড়িয়ে পড়ছে। এক তালে যেন শুনাচ্ছে কোন সমুদ্রের আহবান। বালুকাময় সৈকতে দিনের প্রথম সূর্যের আলোয় স্বর্ণালী রুপ ধারন করেছে যেন পুরা দ্বীপটা৷ পিছে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছের সাথে কেয়া বনের ঝাড়, চোখ জুড়ানী এক সৌন্দর্য্য নিয়ে ধরা দেয় এই কিশোর মনে৷ এতটা দাগ কেটেছে এত বছর পর এসেও তা ভুলতে পারি না। সে এক মাতাল করা দৃশ্য৷ সাগরের নীল পানি আর আকাশের নীলের মিতালি, নীল বেদনায় সিক্ত এই মনে ভেসে উঠলো এক কিশোরীর মুখ৷

প্রিয় নীলাম্বরী তোমার শাড়ীর ভাজে কি লুকিয়ে রেখেছিল এই আকাশটা কে, বন্ধ হল আমার আকাশ দেখা আজ তোমার পানে চেয়ে৷ হৃদ মাঝারে বইছে তোমার নীলাভ সাগরের ঢেউ, কূল নাই কিনার নাই এত সুখের বীণা বাজে আজ এই নারিকেল জিঞ্জিরার মাঝে।

কচি কচি ডাব গুলো অসহায় ভাবে তাকিয়ে ছিল। পুরা দ্বীপটা যেন এক ভ্রামমাণ ডাবের বাগান। হেটে হেটে ঘুরে ঘুরে ডাব তৃষ্ণাটা আর বেড়ে গেল। এই দ্বীপের মানুষ গুলো আলা ভোলা ঠিক সাগরের স্রোতধারার মত সরল। চুরি ডাকাতি বেইমানি এরা শিখে নেই। এক ডাব বাগানে ঢুকে পেয়ে গেলাম সালাম চাচা কে। উনার কথা অনেক দিন মনে থাকবে। চাচা ছিলেন একজন সত্যিকারের পরিব্রাজক। দেশের বাড়ী ফেনী। কাজ করেছেন বাংলাদেশ নেভীতে৷ সাত ঘাটের জল খেয়ে কি ভাবে সেন্ট মার্টিন আসলেন সে গল্প না হয় জমা থাক৷ চাচা এত গুলো ছেলে কে দেখে বেশ খুশি হল। নিজে গাছে উঠে পেড়ে দিল ডাব। ৫ টাকা পিস৷ প্রথম চুমুকেই পরাণটা জুড়িয়ে গেল। এ যেন বিধাতার তরফ থেকে আমাদের জন্য দেওয়া স্বর্গীয় পানি। মা শা আল্লাহ, সুবহান আল্লাহ, আল হামদু লিল্লাহ সব প্রশংসামূলক শব্দ বের হয়েও যেন কম পড়ে গেল৷ মূত্র বির্সজনের এক প্রবল বেগ পেয়ে গেলে সাথে পেটে যেন বইছে ক্ষুধার সমুদ্র। লজ্জা কে বির্সজন দিয়ে চলে গেলাম বে অফ বেংগল। হে মাদার নেচার তোমার সন্তানদের গ্রহণ কর৷ এতক্ষনে আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে বর্জ্য বির্সজন কোথায় হয়েছে। আগানে বাগানে বালুকায় বে অফ বেংগলে গর্জনে প্রবল বেগে করেছি আমরা বর্জ্য বির্সজন। তাকে মাটি চাপা দিয়ে সুখের নহর বইছিল দেহ মনে। আহ কি সুখ৷

সালাম চাচা আমাদের নিয়ে গেলেন লোকাল বাজারে৷ তার সাথে আমরা সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। এরপর বাজারটা ঘুরে ঘুরে হরেক রকম মাছের পসরা দেখলাম। রুপচাদা, কোরাল, টুনা নাম না জানা হরেক রকম মাছ৷ বাজার ঘুরে বসলাম এক চায়ের দোকান। দোকানী বেশ মিশুক। উনার বিশেষ কোয়েকার দেওয়া চা আমাদের খেতে দিলেন। খাটি দুধের সাথে কোয়েকার আর কিছু কাচা চা পাতীর সাথে চিনির মিশ্রণে এক অদ্ভূত চায়ের টেস্ট পেলাম। এর পরে অনেক বার গিয়েছি সেন্ট মার্টিন কিন্তু সেই কোয়েকার চা আর পাই নেই। তখনকার যুগে ছিল না ডেস্টিনেসন হ্যান্টিং। আমরা শুয়ে বসে লেটিয়ে আনন্দে গল্প গুজব করে সময় কাটাতে লাগলাম। এরপর দল বেধে নামলাম সমুদ্রে স্নানে। ঢেউয়ের সাথে খেলার অকৃত্রিম আনন্দ থেকে ছেলে বুড়ো খোকা কেউ বঞ্চিত হতে চায় না। বড় বড় ঢেউয়ের উপর ঝাপিয়ে পড়া, ঢেউয়ের স্রোতে তীরে ফেরা, আবার প্রবল উৎসাহে সামনে এগিয়ে চলা। কি ভাবে যে দুপুর হয়ে গেল টেরই পেলাম না। দুপুরের খাবার সারলাম চান্দা মাছ দিয়ে৷ আবার তাবু পিচ করতে হবে। একটা জ্যোৎসা স্নাত পূর্ণিমা রাতের হাতছানি দিচ্ছে৷

আলস বিকালে সাগরের মাতালী হাওয়ায় দেহে আলসামী ভর করে। ছেড়া দ্বীপের সপ্ন বাদ দিয়ে তাই গল্প গুজবের মাঝে কেটে গেল পুরো বিকাল। এক সময় সন্ধ্যা গড়িয়ে নেমে এল রাতের আঁধার৷
শেষ অধ্যায়ঃ আধারে তুমি পূর্ণিমা চাঁদ

রাতের আঁধারে সমুদ্রের হুংকারে মন এক আজানা সুরে গেয়ে উঠে জ্যোৎসার গান। চাদের আলো যেন গলে গলে পড়ছে চিকচিকে বালুর বুকে৷ সুনসান এই নিরবতার মাঝে চন্দ্রস্নাত হয়েছে কেউ, কেউবা আবেশেই মুগ্ধিত। গভীর রাত পর্যন্ত চলে আমাদের এই পূর্ণিমার আলোয় জ্যোৎসা স্নান। এক ফালি পূর্ণিমা চাঁদ সব গ্লানি মুছে যাক৷ নিদ্রাদেবী যখন পরম মমতায় পৃথিবী টাকে ঘুম পাড়াচ্ছে তখন আমার চোখে ঘুম নাই৷ জীবনানন্দের কবিতার মত যেন আমার মরিবার হল সাধ। সুকান্তের কবিতার মত পূর্ণিমার চাঁদটিকে মনে হল আমার এক ফালি রুটি৷ আমি ক্ষুধার রাজ্যে চলে গেছি৷ এ ক্ষুধা যে জ্যোৎসা স্নাত পূর্ণিমা রাতের ক্ষুধা। যত দেখি আমার ক্ষুধা মিটে না। পরিষ্কার আকাশে ধোয়াসে তারার মাঝে পূর্ণিমার চাঁদে বুঁদ হয়ে থাকে আমার এই মন। গুণগুণিয়ে উঠি উইনিং এর গান।

আঁধারে তুমি পূর্ণিমা চাঁদ হৃদয়ে আমার সাধনার গোলাপ চোখে উষ্ণতা তোমার আবেশ জাগায় অধরে কোমলতা যেন মনকে রাঙায় জীবন জাগানো আলো দিয়েছ তুমি আঁধারে তুমি পূর্ণিমা চাঁদ হৃদয়ে আমার সাধনার গোলাপ

খুব সকালে সূর্যের প্রথম কিরণ জানান দিল আমাদের নতুন এক দিনের৷ সাগরে জোয়ার চলছে। মোক্ষম সময় ছেড়াদ্বীপ হেটে যাবার। আবার ক্যাম্প সাইট গুটিয়ে রওনা হলাম আমরা ৫ জন। এই দ্বীপে আজই আমাদের শেষ দিন৷ ছেড়া দ্বীপ দেখে চলে যাব আজই। দক্ষিণ বিচের নির্জন প্রকৃতির মাঝে কেয়া বন সুশোভিত রাস্তা বুঝতে দিচ্ছে না আমাদের রোদের প্রকোপ। এখানে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে বড় বড় ঢেউ, প্রবালের গায়ে আছড়িয়ে পড়ে সফেদ ফেনা হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে আশেপাশে৷ ছেড়াদ্বীপ যাবার পুরাটা পথই ছিল রোমাঞ্চকর৷ আমার দেখা ১০ বছর আগের সেন্ট মার্টিন আর বর্তমান সেন্ট মার্টিনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য৷ সেন্ট মার্টিন আসলে ছেড়া দ্বীপ না গেলে তো তার জীবন ষোল আনাই বৃথা৷ প্রকৃতি দেবী এক অপার সৌন্দর্য্যের আধার নিয়ে বসে আছে তার পিপাসুর কাছে৷

ছেড়া দ্বীপ যাবার প্রায় পুরাটা পথই দেখতে পারবেন অজস্র সাদা কালো প্রবাল, শামুক-ঝিনিক৷ কখনও পাথুরে পথের সাথে চিকচিক করছে সাদা বালু, কেয়া বনের ঝাড় এক মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে৷ অনুমানিক দুই ঘন্টার হাটার পর আমরা দেখা পেলাম ছেড়া দ্বীপের৷ চান্দি ফাটা রোদে সবাই মোটামুটি কাহিল৷ এখানে ম্যানগ্রোভ বনের সারিতে তাই খানিকটা যাত্রা বিরতি দিলাম সবাই৷ এখানকার সাগর কেমন আমাদের এ নিয়ে কোন ধারনা নাই৷ তাই ঠিক করলাম যত কস্ট হক এখানে গোসল করতে নামবো না৷ মূল সেন্ট মার্টিনে ফিরে গিয়ে আবার হবে সমুদ্র স্নান। আবার চলতে শুরু করলাম। আর একটু সামনে গিয়ে বুকটা ধক করে উঠলো৷ ছেড়া দ্বীপের ছেড়া অংশ পাড়ি দিতে হবে প্রায় গলা সমান পানির পথ পারি দিয়ে৷ কেউ সাতার জানি না। আল্লাহ খোদার নামে পারি দিয়ে উঠে আসলাম তীরে৷ হাটতে হাটতে চলে এলাম ছেড়া দ্বীপের একেবারে শেষ মাথায়৷ এইটাই বাংলাদেশের শেষ ভূ-সীমা। লেজের মত অংশটা আমাদের মানচিত্রের শেষ সীমা৷ বসে পড়লাম একটা প্রবালের উপর৷ বিশাল বিশাল ঢেউ, স্বচ্ছ, নীলাভ, সবুজ জলরাশির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম৷ মনটা আমার গাংচিল পাখির মত উড়ে চলে যেতে চায় এই দিগন্তের নীলিমায়। আহা কি অপূর্ব দৃশ্য। এবার ফেরার পালা৷ একই পথ দিয়ে আমরা চলে এলাম আবার সেন্ট মার্টিনের মূল ভূ-খন্ডে৷ সমুদ্র স্নান করে এবার ফেরার পালা৷ ট্রলার চেপে আমরা ফিরে এলাম আবার টেকনাফ মনে অজস্র স্মৃতি নিয়ে৷ এই দ্বীপ মনে এতটা দাগ কেটেছে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে পঞ্চমবারের মত ফিরে আসি আবার এই দ্বীপে৷ আবার সেই ট্রলার আবার সেই ক্যাম্পিং। যেন ফিরে আসা সেই ১০-১২ বছর আগের নস্টালজিয়া৷ স্মৃতি কাতর মানুষ লিখতে গিয়ে মৌসুমবিহীন এই সময়ে লিখে ফেললাম নীল পরীদের দেশের কথা। পরের ১০ বছরে হয়তো এই দ্বীপটা আর ধংসের পথে যাবে। তবে মনে দাগ কেটে থাকবে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হিসাবে৷

“যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখুন।”
ট্রাফিক আইন মেনে চলুন৷ ফুট ওভার ব্রীজ, জেব্রা ক্রসি, আন্ডার গ্রাউন্ড পাস ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।