সাগরকন্যা কুয়াকাটা

কুয়াকাটা যাবেন যাবেন করছেন, কিন্তু যাওয়া হচ্ছে না ? আবার অনেকেই কুয়াকাটা গিয়ে সাগর দেখেই ঘরে ফিরে এসেছেন ? এবার ঝটপট প্লান করে ফেলুন, সামনের ছুটি তে কুয়াকাটাকে দেখবেন নতুন চোখে । এবার নিজেই এক্সপ্লোর করবেন , কোন মায়ার জাদুতে কুয়াকাটার নাম হয়েছে সাগরকন্যা ।

আমার কুয়াকাটা ভ্রমণের আগে আমিও সবার মতই গুগলিং করেছিলাম। অনেক দরকারি তথ্য সবখানেই আছে । তবে কিছু ব্যাপার আমি এর আগে কোথাও পাইনি । আজ সেগুলো আমার অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের সাথে শেয়ার করব । আর সাথে থাকবে কিছু টিপস যেটা আপনার ট্রিপ কে করবে ঝামেলামুক্ত ।

সবাই যে ভুল্গুলো করে তার মধ্যে একটি হল বাসে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা বা পটুয়াখালি যাওয়া । আমার জীবনের প্রথম লঞ্চ জার্নির আগে আমারও অনেক ভুল ধারণা ছিল সেফটির ব্যাপারে । কিন্তু পরে এই ভুল ধারণা ভাঙ্গে । সদরঘাট থেকে সরাসরি বিভিন্ন জেলা সদরের জন্য যে লঞ্চগুলো ছেড়ে যায় সেগুলো বেশ বড় আর নিরাপদ । আর বাস জার্নির তুলনায় লঞ্চ জার্নি অবশ্যই হাজার গুণে আরামদায়ক, আর বোনাস হিসেবে পাবেন সকালে নদীর ভিউ । বরিশালের লঞ্চে গেলে এটা হবেনা , অবশ্যই পটুয়াখালির লঞ্চে যাবেন এর জন্য ।

 কুয়াকাটা

সকালে লঞ্চঘাটে নেমে অটো নিয়ে চলে যাবেন বাসস্টপেজে । লঞ্চঘাটের তুলনায় এখানে নাস্তার খরচ কম হবে । এরপর বাসে বসে চলে যাবেন একেবারে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টে । ওখান থেকে আশেপাশে নানা রকম হোটেল আছে, বাজেট অনুযায়ী হোটেল নিবেন । বাজেট কম থাকলে জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিমদিকে গলির ভেতরদিয়ে যাবেন অনেক সস্তায় থাকার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে । আবার ৮ জনের টিম হলে মিডিয়াম রেঞ্জের হোটেলেই ১০০০ টাকায় পেয়ে যাবেন ডাবল বেডের রুম । বেডগুলো অনেক বড় তাই বেশি মানুষে থাকতে কষ্ট হবেনা ।

একটা দরকারি কথা বলাই হয়নি, তা হল লঞ্চ থেকে নামার পর থেকে বাকি পুরোটা ভ্রমণের সময় আপনাকে যথেষ্ট দামাদামি করে চলতে হবে । অটোর ভাড়া, বাস ভাড়া, হোটেল নেয়ার সময় , ঘোরার জন্য বাইক ভাড়া করতে,– সবখানেইই। হোটেল নেয়ার ঝামেলা শেষ হতে খুব হলে বেলা ১১ঃ৩০ হবে । এরপর সাগরে ঝাপিয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর সময় । দুপুর ২ টার মধ্যে ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ৩ টার মধ্যে লাঞ্চ করে বেরিয়ে পরবেন । এখানে ঘোরার জন্য আপনার দুইটা অপশন, ভ্যান অথবা বাইক । আমি অবশ্যই বাইকের কথা বলব, কারণ এ ছাড়া সবগুলো স্পট ঘোরা প্রায় অসম্ভব ।

 কুয়াকাটা

এখানকার বাইকওয়ালারা অনেক ধুরন্ধর, তাই আপনাকে দামাদামি করতে হবে অনেক । এখানে বলব ভুল নম্বর ২ এর কথা । সবাই সাধারনত একেবারে সবগুলো স্পট ঘোরার জন্য বাইক ভাড়া করে । আমি বরং শুধুমাত্র পশ্চিমদিকের বিচ আর স্পটগুলো দেখার জন্য ভাড়া করলাম। এক্ষেত্রে ২০০-৩০০ টাকায় বাইক ভাড়া নিবেন ।

লেবুর বন, শুটকিপল্লি , তিন নদীর মোহনা দেখবেন । ফেরার সময় সানসেট পয়েন্টে সূর্যাস্ত দেখে জিরো পয়েন্টে এসে ভাড়া বুঝিয়ে দিবেন বাইকওয়ালা কে ।

সন্ধার পরটা নিজের মত কাটাবেন , ঘুরবেন ফিরবেন, খাবেন । আপনি রসিক মানুষ হলে আকাশ ভরা তারা আর চাদের সাথে মেঘের লুকোচুরি উপভোগ করবেন । রাতে তারাতারি ঘুমুতে হবে কারন সকালে নয়া উঠলে সূর্যোদয় মিস । সকালে আপনাকে ফজরের আগে উঠতে হবে । জিরো পয়েন্টে এ সময় আসলেই দেখবেন অনেক বাইক, আপনাকে টানাটানি করবে । পূর্বদিকের সবগুলো স্পট ঘোরার জন্য দরদাম ঠিক করবেন বাইকপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা ।

বরিশালের গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদ
বরিশালের গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদ

এরপর বাইক আপনাকে দেখাবে সূর্যোদয়, ছোট খাল নৌকায় পেরিয়ে গিয়ে দেখবেন , তাহলভাল ভিউ পাবেন । এরপর ঝাউবন , লাল কাকড়ার চর দেখবে আপনাকে । বাইকার কিন্তু ঝাউবনের মাঝদিয়ে আপনাকে রাখাইনপল্লিতে নিয়ে যেতে চাইবে আর বলবে বিচ বরাবর আর কিছু নেই দেখার মত । আপনি তাকে সামনে থেকে ঘুরিয়ে আনতে বলবেন । আমরা বিচের শেষ পর্যন্ত ঘুরে এসেছিলাম । সেটা ছিল এক অন্যরকম অনুভুতি ।

এরপর রাখাইন পল্লির ভেতর দিয়ে ঘুরে জিরো পয়েন্টে চলে আসবেন । মাঝে আরও দেখাবে মন্দিরদুটো, কুয়াকাটার কুয়া । তবে এগুলো আপনি চাইলে পায়ে হেটেই দেখে নিতে পারেন খুব কাছেই ।

এবার ছোট্ট করে কিছু টিপসঃ
১। কুয়াকাটা যাওয়ার জন্য বেষ্ট সময় শরতের শেষে ,আর শীতের শেষে । আর আমি বরাবরের মতই অফ সিজনে যেতে পছন্দ করি । এসময় টুরিস্টও কম যায়, তাই হোটেল দেখে শুনে দামাদামি করে নেয়া যায় । প্রেশার কম থাকে । তাছাড়া যাবেন সুরযদয়-সুরযাস্ত দেখতে । তাই ডিসেম্বর-জানুয়ারির কনকনে শীতে গেলে টুর হবে যেমন তেমন । দেখা হবেনা সূর্যাস্ত ,কুয়াশার জন্য । এছাড়া তখন লোকের ভিড়ে কুয়াকাটা থাকে ভরপুর ।

২। ঢাকা থেকে গেলে বাসের বদলে লঞ্চে যাওয়া অবশ্যই অবশ্যই বেটার চয়েজ ।

৩। যাওয়ার আগে ঘোরাঘুরির স্পটগুলো কোথায়,কতদুর ইত্যাদি গুগলে হাল্কা স্টাডি করে যাবেন, তাহলে বাইকারের কাছে ঠকার চান্স কম থাকে ।

৪। হোটেল বুকিং দিয়ে নেয়ার চেয়ে গিয়ে দামাদামি করে নেয়া সস্তা হবে ।

৫। যারা সস্তায় লান্স দিনার করতে চান, তাদের জন্য আছে বিচের পশ্চিমদিকে কিছু ছোট হোটেল ,যেমন এক্টির নাম “সূর্যোদয়” । নানা রকম ভরতা দিয়ে ভাত খেতে খরচ পরবে ৩০-৪০ টাকা মাত্র !

৬। কুয়াকাটা আপনার প্রথমবার ভ্রমণ হলে অবশ্যই স্পটগুলো ছাড়াও আশেপাশের এলাকা একটু ঘুরে দেখবেন । শুধু সৈকতে ঘুরলেন, তো মিস ।  পুরো কুয়াকাটাই অনেক সুন্দর ,সবটা মিলেই কিন্তু সাগরকন্যা !

৭। বছরের বিশেষ সময় ও ছুটির দিনগুলোতে গেলে বাজেট অবশ্যই বেশি থাকতে হবে এবং উপরের সাজেসন্স গুলো সেক্ষেত্রে সেভাবে কাজে দিবে না !

৮। কুয়াকাটায় কিন্তু কোন well known ব্যাংক এর বুথ নেই! বিকাশ আছে। তাই যারা কেবল এটিএম ব্যাবহার করেন তারা অবশ্যি ক্যাশ টাকা নিয়ে যাবেন।

আমার কাছে শুধু সাগরস্নানের জন্য কুয়াকাটা কক্সবাজারের চেয়ে বেটার অপশন । কারণ লঞ্ছভাড়া ৩০০+৩০০, বাসভাড়া ১০০+১০০, হোটেল ভাড়া জনপ্রতি ২০০-৩০০ (গ্রুপের আকার অনুযায়ী), খাওয়া খরচ প্রতি বেলায় ৪০-১৫০(বাজেট অনুযায়ী) । তাছাড়া লঞ্চের আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য ক্লান্তি ছাড়া ঢাকায় এসেই প্রতিদিনের কাজকর্ম শুরু করতে পারবেন ।

ভ্রমণের একটি ব্যাপার এবার শেয়ার করব যেটায় আমি ব্যাক্তিগতভাবে অনেক কষ্ট পেয়েছি । প্রথমবার সাগরে লাফিয়ে পড়ার উত্তেজনা নিয়ে যখন ছুটে গিয়ে সৈকতে নামলাম, প্রথমেই বামদিকে দেখলাম প্লাস্টিকের বোতল আর আবর্জনার স্তুপ । এছাড়া প্রতিটি সুন্দর স্থানে , যেখানে বসে একটু জিরাতে গেছি , সেখানেই দেখি চিপ্সের/সিগারেটের প্যাকেট ইত্যাদি ইত্যাদি। এই জিনিসগুলো কিন্তু শুধু আমার না, সকলের কাছেই “কাবাব মে হাড্ডি”র মত । আর এটা কিন্তু আমরাই করি । একটা অনুরোধ থাকবে, এভাবে এত সুন্দর স্থানগুলো আমরা যেন নোংরা না করি । এই সুন্দর দেশ, সুন্দর সব জায়গা, সবই তো আমাদেরই ,তাইনা !
আপনার নিরাপদ এবং আনন্দময় ভ্রমণের প্রত্যাশা রইল 🙂